সেটা অভিনয় কিনা বোঝা যায়নি। অত বুদ্ধি সন্ধ্যার নেই। কান্নার জবাবে সেও কেঁদে ফেলেছিল। তার বর অনুনয় বিনয় করে বলেছিল, তুমি মোরো না। মরলে আমার বড় কষ্ট হবে। তুমি মরলে আমাকেও মরতে হবে।
কেউ মরেনি শেষ অবধি। বরের সঙ্গে সন্ধ্যার আইনমাফিক ডিভোর্সও হয়নি। বর বলেছিল, ডিভোর্স করলে অনেক হাঙ্গামা। তুমি ব্যাপারটা মেনে নাও। আমি জানি তুমি ভাল মেয়ে, কিন্তু আমার যে কোনও উপায় নেই।
সন্ধ্যা চলে এল। বর তাকে বর্ধমান স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বাসেও তুলে দিয়ে গেল। চোখের জল ফেলতে ফেলতেই বিদায় নিল। নিজের বর সম্পর্কে একটা ধাঁধা তাই আজও আছে সন্ধ্যার। ফেরত হওয়ার পরও তার আশা ছিল মানুষটা হয়তো ভালই। একদিন ভুল বুঝতে পেরে তাকে ফের নিয়ে যাবে।
তা অবশ্য হয়নি। লোকটা বছরখানেক বাদেই আর একটা মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে। সন্ধ্যা খবরটা পেয়েও মামলা মোকদ্দমা করতে যায়নি। কী হবে হাঙ্গামা করে? গাঁয়ে তাদের পরিবারের একটা সম্মান তো আছে। আশ্চর্যের বিষয় তার দাদারাও কেউ তার হয়ে লড়তে যায়নি, কোনও ব্যবস্থাও করেনি খোরপোশ আদায়ের। শুধু তার বাবা মহিম রায় গিয়ে জামাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। জামাই তাঁরও পায়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে “আমাকে জুতো মারুন, আমাকে ফাঁসি দিন” বলে অনেক বিলাপ করে। মহিম রায় অপ্রস্তুত হয়ে ফিরে আসেন।
মনের বিষণ্ণতা এবং ঘটনার আকস্মিকতা কাটতে এবং চোখের জল শুকোতে একটু সময় লাগল সন্ধ্যার। বছর দুয়েক। তার মধ্যেই সে বুঝে গেল সংসারে তার অবস্থান গলগ্রহের মতো। কোনও সম্মান নেই, কেউ গুরুত্ব দেয় না, বাঁকা কথা কানে আসে, পাড়া প্রতিবেশীরাও টিটকিরি দিতে ছাড়ে না।
এই অপমান ভুলতেই একদিন সে কাজে নেমে পড়ল। কাজে তার কখনও কোনও আলস্য ছিল না। বরাবরই তার শরীর খুব মজবুত। প্রথমে আচার নিয়ে পড়ল সন্ধ্যা। তারপর কাসুন্দি। অনভিজ্ঞতার ফলে দাম হয়ে গেল বেশি। নগেন হালদার নামে একটা ফড়ে ধরনের লোক এসে একদিন বলল, ওভাবে কি হয় দিদি? দামের ঘাট বাঁধা আছে। খরচ কমাও, নইলে পরতায় আসবে না। ব্র্যান্ডের মালের চেয়ে কম দামে না দিলে লোকে নেবে কেন? তা নগেন হালদারই তাকে খুব সাহায্য করল। এমনকী তার তৈরি জিনিস শহরের দোকানে দোকানে পৌঁছে দেওয়া অবধি। একটু একটু করে পয়সা আসতে লাগল। গত সাত আট বছর ধরে সন্ধ্যার যে-পরিশ্রম তার ফল আজ সে পায়। ব্যবসা তার বিরাট বড় কিছু নয়, কিন্তু তার জিনিস চলছে শহরে গাঁয়ে, চাহিদা বেড়েছে। এখন মাসে তার কম করেও তিন চার হাজার টাকা রোজগার।
পারুল এ সবই জানে। তিন রকম আলোয় সন্ধ্যার মুখশ্রীতে সে যে সৌন্দর্য আজ দেখতে পেল তা সে আগে দেখেনি।
সন্ধ্যা তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে নিজে একটা টুলে মুখোমুখি বসে দুঃখের গলায় বলল, হরিজ্যাঠা মারা যাওয়ায় এত খারাপ লেগেছিল যে কী বলব। মনে হল আপনজনই কেউ চলে গেল। আপনজনই তো, না কী বল পারুলদি! হরি জ্যাঠা মরে যাওয়াতে বাবাও খুব ভেঙে পড়েছে। কেবল বলছে, এই হরিদা চলে গেল, এবার আমার পালা।
পারুল বলল তা কেন, মহিমকাকা তো বাবার চেয়ে অনেক ছোট।
অনেক নয়। বাবা তো বলে পাঁচ ছয় বছরের তফাত। আজকাল কারও মরার খবর পেলেই বাবা কেমন ধড়ফড় করে।
এই বয়সে হয়।
বাবার ঊনআশি চলছে। আমাদের সকলেরই কেমন বয়স হয়ে যাচ্ছে, না রে পারুলদি?
তোর আবার বয়স হল কোথায়? বেশ তো আছিস। তোকে দেখে আমার বড্ড ভাল লাগছে। বেশ নিজের চেষ্টায় দাঁড়িয়ে গেছিস।
সলজ্জ হেসে সন্ধ্যা বলে, দাঁড়ানো মানে আর কী? আমার তো ছোট ব্যবসা। কষ্টেসৃষ্টে চলে যায়।
পাড়াগাঁয়ে থেকে যা করেছিস ঢের করেছিস। তোর রোখ আছে, আর এইজন্যই তোকে ভাল লাগে।
এইটুকুর জন্যই বেঁচে গেছি পারুলদি। নইলে এ-বাড়িতে ঝি-গিরি করে খেতে হত।
সেই লোকটা আর খোঁজখবর করেনি, না?
না। খোঁজখবর করবেই বা কেন? সুখে সংসার করছে।
তোরা কাজটা ভাল করিসনি সন্ধ্যা। লোকটাকে ছেড়ে দিলি কেন? একটু শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল।
ধরতেই তো পারলুম না, ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছিস কেন? ওসব আর ভাবিই না। আমার কপালের দোষ। তোর মতো সুন্দর হয়ে জন্মালে কি আর সে আমাকে ছাড়ত?
পারুলের খুব দুঃখ হল কথাটা শুনে। একটু ভেবে বলল, তুই যে কত সুন্দর তা দেখার মতো চোখ কটা পুরুষের আছে? এই যে দিনরাত হাড়মাস নিংড়ে কাজ করছিস, এই যে স্নো-পাউডার মাখিস না, সাজিস না, এই যে লড়াই করছিস এর জন্যই তো তুই সুন্দর।
সে তো তোর চোখে। পাঁচজনের চোখে তো নয়।
বউ সুন্দর হলেই বা। স্বামীর চোখে সেই সৌন্দর্যের আয়ু কতটুকু? কিছুদিন পর তো আর হাঁ করে তাকিয়ে বউয়ের সুন্দর মুখ দেখে এলিয়ে পড়বে না। তখন অন্য সব পয়েন্ট প্রমিনেন্ট হবে, কাজের মেয়ে কি না, বুদ্ধিমতী কি না, যত্নআত্তি করে কি না।
সে তো ঠিক কথাই পারুলদি। কিন্তু সে কথা ওই মেনিমুখোকে বোঝাতে পারলুম কই? আমি কাছে গেলেই ওর বোধহয় মনে হত একটা ভালুক আসছে।
পারুল হেসে ফেলল।
সন্ধ্যাও একটু হেসে বলে, তোর ব্যবসার কথা বল পারুলদি। তোর বর নাকি মস্ত ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।
দুর বোকা, বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হওয়া কি সোজা? আদিত্যপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে আমাদের কারখানা। ছোট ছোট পার্টস তৈরি হয়। তেলের লাইনের জয়েন্ট, আরও সব ছোটখাটো জিনিস। টাটা স্টিল, টাটা অটোমোবাইল, রেল এরাই নেয়। কিন্তু এই একরত্তি একটা জিনিস তৈরি করতেও কতরকম ড্রয়িং, কত মাপজোখ, আর আটটা নটা অপারেশন দরকার হয়। তাই ভাবি বড় বড় কলকারখানায় আরও কত কমপ্লিকেটেড বাপার। ভাবলে মাথা ঘুরে যায়।