অমল রায় বোম্বে চলে যাওয়ার পরই একদিন পারুল তার মাকে বলল, তোমরা যদি আমার বিয়ে দিতে চাও তাহলে আর দেরি কোরো না।
মা ভ্রূ তুলে বলল, অমলকে?
না মা, তোমরা পছন্দ করে দেখো।
মা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল, বাঁচালি মা। ও ছেলে সম্পর্কে যা সব কানে আসছে আমার বুকটা কেমন দুরদুর করে। তোর জন্য তো পাত্রের অভাব হবে না।
হয়ওনি। পাত্রের গাদি লেগে গিয়েছিল। সুন্দরী মেয়েদের জন্য যা বরাবরই হয়। বিলেত আমেরিকা বা প্রবাসী বাঙালি সরিয়ে রেখে একজন ভালমানুষ, কর্মঠ, স্বনির্ভর লোককে বেছে নেওয়া হয়েছিল। পারুলের আপত্তি হয়নি। মানুষটি খুব সুপুরুষ নয়, কিন্তু তার চোখে একটা যোগীচক্ষুর ভাব ছিল। কষ্ট করে ওপরে উঠেছে। জামশেদপুরে তার নিজস্ব কারখানা। ছোট যন্ত্রাংশ তৈরি করে। সবচেয়ে বড় কথা, কর্মচারীরা তাকে ভীষণ পছন্দ করে।
বিয়ে হয়ে গেল। কাজটা অমল রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হল কি না তা ভেবে পেল না পারুল। কিন্তু মনটা মেঘমুক্ত হয়ে গেল, সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবং লোকটাকে হঠাৎ ভালও বেসে ফেলল। স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ গাঙ্গুলি তাকে স্পোকেন ইংলিশ শেখাল, সেক্রেটারিয়েটশিপ প্রশিক্ষণ নেওয়াল, এবং ঘরে বসিয়ে না রেখে ব্যবসার সঙ্গী করে নিল। কী সাংঘাতিক পরিশ্রমী মানুষটা! আর ভীষণ সৎ। কথার নড়চড় করে না কখনও। রাগ বলে কিছু নেই। একবারও ভালবাসার সাজানো বানানো মিথ্যে কথাগুলো বলেনি তাকে, কিন্তু পরম বিশ্বাসে নির্ভর করেছে পারুলের ওপর। এরকম সংবর্ধনা কটা স্বামী দিতে পারে তার স্ত্রীকে!
পারুল আজ অপেক্ষা করছে অমল রায়ের জন্য। এতদিন পর কেমন লাগবে মানুষটাকে? হয়তো তার জন্য কেঁদেছে লোকটা, মন খারাপ করেছে। কে জানে কী। এই কৌতূহল নিশ্চয়ই ক্ষমার যোগ্য। তারা বদলে গেছে।
গৌরহরি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রাদ্ধে আজ আসবে অমল রায়। মস্ত প্যান্ডেলের নীচে লোক জড়ো হচ্ছে ধীরে ধীরে। বহু লোক আসবে। পারুলের আজ ব্যস্ত থাকার কথা। তবু পারুল এক ফাঁকে আজ এসেছে বাগানে। একা। আজ সেই কিশোরীবেলার পারুলকে খুব মনে পড়ছে তার। কী ছেলেমানুষ ছিল সেই পারুল! কী বোকা।
হঠাৎ একটু শক্ত হয়ে গেল পারুল। মাত্র দু হাত দূর দিয়ে একটা লম্বা, প্রকাণ্ড গোখরো সাপ চলে যাচ্ছে। গলায় একটা ঢিবি। যেতে যেতে তাকে একবার পাশ-চোখে দেখে নিল কি? পারুল নড়ল না। পলকহীন চোখে চেয়ে রইল সাপটার দিকে। উচ্চাবচ ভূমি আর গাছ আর পাতার আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে সাপটা।
বিড় বিড় করে পারুল বলল, আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি, আস্তিক মুনি।
.
০২.
সন্ধেবেলার ঝুঁঝকো আঁধারে হঠাৎ তাকে দেখে খুব অবাক আর খুশি হয়ে সন্ধ্যা বলে উঠল, পারুলদি না কি? ও মা, আয় আয় পারুলদি! কতদিন পর!
যারা কাজ করে, যারা বেঁচে থাকার জন্য ক্রমাগত লড়াই করতে থাকে তাদের সৌন্দর্য বুঝতে পারে পারুল। ভাবালু মানুষ বা কামুক কখনও এই সৌন্দর্য খুঁজে পায় না। তাদের চোখে সন্ধ্যা কালো, বেঁটে, একটু মোটা, ছোটো ছোটো চোখ এবং লাবণ্যহীন মুখ। বয়সও হল সন্ধ্যার। হিসেবমতো তেত্রিশ বা চৌত্রিশ।
সন্ধ্যা যখন আবেগবশে তাকে জড়িয়ে ধরল তখন তার গা থেকে ঘাম আর নানা মশলার একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পেয়েছিল পারুল। সেন্ট, পাউডার, রূপটানের কোনও গন্ধ নয়।
এসবই পরশু দিনের কথা। এ-বাড়িতে গত কুড়ি বছর আসেনি পারুল। বাপের বাড়িতে এলেও এ বাড়িতে কখনও নয়। কিন্তু পরশুদিন নিশিতে পেয়েছিল তাকে, যখন শুনল, অমল রায়ের বউ আর ছেলেমেয়ে গাঁয়ের বাড়িতে এসে কয়েকদিন ধরে রয়েছে। অবাক হওয়ার মতোই খবর। পারুলের বিয়ের এক বছরের মধ্যেই অমল রায় বিয়ে করে। হয়তো পারুলের ওপর ওটা একটা নিষ্ফল প্রতিশোধ। তারপরই জার্মানিতে চলে যায়। বছর পনেরো বাইরে বাইরে কাটিয়ে বছর পাঁচেক হল কলকাতায় ফিরে বড় চাকরি করছে। গাঁয়ে আসবে কখন তারা? সবাই যে ভীষণ ব্যস্ত। আর আসবেই বা কেন? বুড়ো বাপ আজও বেঁচে আছে বলে অমল মাঝে মাঝে আসে। খুব দায় না ঠেকলে ওর বউ ছেলেমেয়েরা কখনও নয়।
আয়, ঘরে আয় পারুলদি। তোকে একটু দেখি।
সন্ধ্যার ঘরের মধ্যেও সেই ঝাঁঝালো মিষ্টি টকচা নানারকম গন্ধের রেণু উড়ছে। সারাদিন ও কাসুন্দি, আচার, ডালের বড়ি, আমসত্ত্ব, আমলকীর মুখশুদ্ধি, জোয়ানের হজমি, পাঁপড় এই সব তৈরি করছে। ঘরে উদুখল থেকে শুরু করে প্রকাণ্ড শিল-নোড়া, মশলা গুঁড়ো করার যন্ত্র আর শিশি বোতলের ছড়াছড়ি। ভোল্টেজ কম থাকে বলে ইলেকট্রিকের বাতিতে ঘর আলো হয় না। তাই একটা কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। একটা মোটা মোমবাতির আগুনে দুটো অল্পবয়সি মেয়ে মেঝেতে বসে প্লাস্টিকের প্যাকেটের মুখ জুড়ছে।
ভারী ভাল লাগল পারুলের। একটুও ভাবালুতা নেই সন্ধ্যার। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ও জীবনের একটা হারা লড়াই অন্যভাবে জেতার চেষ্টা করছে।
কত কালো কুচ্ছিত মেয়েরও কত ভাল বিয়ে হয়ে যায়, সুখেই ঘরকন্না করে তারা। সন্ধ্যার কপালটা তত ভাল নয়। তার জন্য পাত্র খুঁজে খুঁজে হয়রান মহিমকাকা অবশেষে দুর্গাপুরের এক পাত্র পেয়ে লটারি জেতার মতো মুখ করে ফিরলেন। পারুল শুনেছে, পাত্রপক্ষের খাঁই ছিল। পঁচিশ হাজার নগদ এবং গয়না আর জিনিসপত্রের বহর বড় কম ছিল না। বিয়ের দু মাসের মাথায় সন্ধ্যা ফেরত হল। কী, না এ পাত্রীকে বরের পছন্দ হচ্ছে না। এমনই অপছন্দ যে, পাত্র বিয়ের পর দুবার বিবাগী হয়ে গিয়েছিল। না, সে সন্ধ্যাকে মারধর করেনি, অত্যাচারও নয়। এর টেকনিক ছিল অন্যরকম। সে নাকি কান্নাকাটি করে সন্ধ্যার কাছ থেকে মুক্তি চাইত। এমনকী পায়ে অবধি ধরতে বাকি রাখেনি। এমন নারাজ পুরুষের সঙ্গে থাকেই বা কী করে সন্ধ্যা? তবু সে তার বরকে বলেছিল, আমি কুচ্ছিত হতে পারি, কিন্তু খেটেপিটে সব পুষিয়ে দেবো। তোমার এমন যত্ন করব যা কেউ কখনও করেনি। একদিন দেখবে আমার চেহারাটার কথা তোমার আর মনেই থাকবে না। আমাকে ফিরিয়ে দিও না, তা হলে আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না। গলায় দড়ি দিতে হবে আমাকে। এ কথা শুনে তার বর ভেউ ভেউ করে কেঁদেছিল।