কুড়ি দিন দম বন্ধ করা টেনশন। পারুল ঘর থেকে বেরোত না। শুধু কাঁদত, মন খারাপ করে বসে থাকত, সারা রাত ভয়ে তার ঘুম হত না। আর ঠাকুর-দেবতাদের ডাকত। নিজের পেটে হাত রেখে অনুভব করার চেষ্টা করত সেখানে কোনও সম্ভাবনার জন্ম হচ্ছে কিনা। ওই কুড়িটা দিন তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়। দুঃস্বপ্নের মতো। একুশ দিনের দিন রজোদর্শন করে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে আর কুমারী নেই বটে, কিন্তু লোকলজ্জা থেকে বেঁচে গেল এ যাত্রা। বেঁচে গেল তার পরিবারও।
তাদের ঠিকে ঝি হেনার মা একদিন রান্নাঘরে মশলা পিষতে পিষতে পারুলের মায়ের সঙ্গে কথা কইছিল। পারুল সেটা শুনে ফেলে।
ওই ছেলের সঙ্গেই কি বিয়ে দেবে নাকি গো মা?
হ্যাঁ, সেরকমই তো কথা চলছে। ছেলে তো রত্ন। কপালে আছে কি না দেখি।
রত্ন কিনা জানি না বাপু, তবে বলে রাখছি ছেলের কিন্তু আলুর দোষ আছে।
কীসের দোষ?
আলুর দোষ গো। স্বভাব ভাল নয়।
কেন কী করেছে?
খড়্গপুরে যখন পড়ত রোজ বেশ্যাবাড়ি যেত।
অ্যাঁ!
আমার বর তো আই আই টি-তেই ঠিকাদারের কাছে কাজ করে। সে বলেছে। একটু ভেবেচিন্তে এগিয়ো বাপু।
সেদিন মায়ের ব্লাড প্রেশার বেড়ে শয্যা নেওয়ার জোগাড়। কিন্তু পারুল একটুও অবাক হল না। যে অত অসংযমী তার পক্ষে এটাই তো স্বাভাবিক। সঙ্গে সঙ্গে পারুলের আর একটা ভয় হল। বেশ্যাবাড়ি যখন যায় তখন আবার খারাপ রোগ-টোগ হয়নি তো! সেই রোগ যদি পারুলের শরীরেও ঢুকে থাকে!
এইভাবেই গাঁয়ের উজ্জ্বল যুবকটির প্রতি তার দুরন্ত প্রেমের অবসান ঘটে গেল একদিন। এমনকী আই আই টি-র পরীক্ষায় অমলের ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার খবরেও বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হল না সে।
ওদের বাড়ি আর যেত না পারুল। অমল কিন্তু প্রায়ই আসত। পাসের খবর নিয়েও হাসিমুখে অমল এসেছিল। তখনও পারুলকে বিয়ে করার কথা ভাবছে। বসে বসে অনেক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলছিল সেদিন।
বিদেশে তো আমাকে যেতেই হবে। ভাবছি তোমার পাসপোর্ট এখনই করিয়ে রাখলে হয়।
কেন?
তোমাকে নিয়েই যেতে চাই।
কেন, ওদেশে কি প্রস কোয়ার্টার নেই?
স্তম্ভিত অমল তার দিকে হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, কী বলছ?
কথাটা বলে লজ্জা পেয়েছিল পারুল। কাউকে সে চট করে অপমান করতে পারে না। মাথা নিচু করে বলল, কিছু না।
কিছুক্ষণ ম্লানমুখে চুপ করে বসে রইল অমল। তারপর দুখানা করুণ চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, কে তোমাকে এসব বলেছে জানি না। তুমি কি এসব বিশ্বাস করো?
বিশ্বাস করব কিনা তা বুঝতে পারছি না। আমার মন ভাল নেই।
ভাবলাম আমার ভাল রেজাল্টের খবর পেয়ে তুমি খুশি হবে।
খুশি হইনি কে বলল? তবে নতুন কিছু তো নয়, তুমি বরাবরই ভাল ছেলে।
আবার কিছুক্ষণ মনোকষ্টে বসে থেকে ম্লান মুখে অমল বলল, তুমি আমার ভাবী স্ত্রী। ব্যাপারটা তুমি এভাবে দেখো। ধরো আমি একজন মনোরুগি, আমার রুচি এবং শালীনতাবোধ দিয়েও আমি আমার ভয়ংকর প্যাশনকে ঠেকাতে পারছি না। তুমি যদি সাহায্য কর তো পারব।
তুমি কি স্বীকার করছ তুমি প্রস কোয়ার্টারে যাও?
অনেকেই যায়। অনেক ভাল লোকে, গণ্যমান্য মানুষও যায়।
তুমি যাও কিনা সেটা নিয়েই আমার দুশ্চিন্তা।
যাই পারুল। আমাকে নিশিতে পায়। কিন্তু বিয়ের পর এভরিথিং উইল চেঞ্জ।
পারুল মাথা নিচু করে বলল, আমার মন ভাল নেই অমলদা। আমার মাথায় কিছু আসছে না।
আমি তোমাকে বড্ড ভালবাসি যে পারুল। সবসময়ে আমি তোমাকে চিন্তা করি। তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা যে আমার পক্ষে অসম্ভব।
তাই তো জানতাম।
তুমি কত নরম-সরম মেয়ে ছিলে, আমাকে দেখলেই তোমার মুখে খুশির ঝাপটা লাগত, কত লজ্জা পেতে আমাকে। এখন তুমি কেমন শক্ত হয়ে গেছ, কেমন মনমরা। ওই একটা শরীরের ঘটনা কি আমার এত বড় অপরাধ? কত ছেলেমেয়েই তো বিয়ের আগে
ওসব বোলা না অমলদা, পায় পড়ি।
আচ্ছা পারুল, বলব না। তবে এটুকু বলে যাই, আজকের দুনিয়ায় ওসব কেউ গায়ে মাখে না। ওটা খুব তুচ্ছ ব্যাপার।
অনেকের কাছে হয়তো তাই।
হতাশায় মাথা নেড়ে বিষণ্ণ অমল বলল, না পারুল, তোমার চোখ বলছে তুমি আমাকে আর চাও না। কিন্তু আমার জীবনটা যে তাহলে বড় একার হয়ে যাবে। তোমাকে ছাড়া যে পারব না আমি। কিছুতেই পারব না। আমাকে কি তাহলে আত্মহত্যা করতে হবে?
ওসব বোলো না অমলদা। আমি এখনও তো তোমাকে কিছু বলিনি। আমাকে ভাবতে দাও। বড় মনে কষ্ট দিয়েছ আমায়। আমাকে এখন ভাবতে হবে।
ভেবে লাভ নেই পারুল। তোমার মনের কথা আমি বুঝতে পেরেছি। একটা ভুল করে ফেলেছি। কী আর করব।
একটু মায়া কি অবশিষ্ট ছিল না পারুলের মনে? ছিল। খুব ছিল। অমল রায় যে তাকে গভীর ভালবাসে তাও সে বোঝে। কিন্তু অমল রায়ের দিকে নিজেকে এগিয়ে দিতে কিছুতেই সে পারছে না। বাধা হচ্ছে।
অমল বোম্বেতে চাকরি পেয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে দেখা করে বলল, যদি ক্ষমা করতে পার তবে করো পারুল। চাকরি পেয়েছি। মাস দুয়েকের ভিতরে বিদেশেও চলে যেতে পারি। আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে নিয়ে যাই। আমার কথা একটু নরম মন নিয়ে ভেবো পারুল।
পারুল ডাকের সুন্দরী। সারা তল্লাটে তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। বিজু বলত, তুই মিস ইন্ডিয়া হতে চাইলে ইজিলি পারবি ছোড়দি। কথাটা মিথ্যেও হয়তো নয়। নানা জায়গা থেকে তার বহু ভাল বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। অমল রায়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর আর বিশেষ প্রস্তাব আসত না।