পারুল চ্যাটার্জি আর অমল রায়ের গভীর প্রেমের ঘটনা মোটেই চাপা থাকেনি। বিশ বাইশ বছর আগে এই ঘটনায় সারা গাঁ তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। পথেঘাটে মজলিশে আলোচনা হত। বিয়েতেও কোনও বাধা ছিল না। সবর্ণ, পালটি ঘর। কিন্তু ঘটনা সবসময়ে সোজা পথে ঘটতে চায় না।
অমল রায় মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল। এই গাঁয়ের মুষ্টিমেয় কৃতী ছেলেদের মধ্যে সে একজন। হয়তো সর্বশ্রেষ্ঠ। মাধ্যমিকের পরও দুরন্ত অমল অনেক বেড়া টপকাল। যা চায় তাই পায় অবস্থা। পারুলকেও পেয়ে গিয়েছিল অনায়াসে। প্রায় কৈশোরকাল থেকে।
ঘটনাটা ঘটেছিল যে সময়ে সে সময়ে আই আই টি-র শেষ পরীক্ষা দিয়ে অমল গাঁয়ে ফিরেছে। দুজনের দেখাসাক্ষাৎ ছিল পরস্পরের বাড়িতে। যাতায়াতের তেমন কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু সেই সময়ে অমলের চোখেমুখে একটা ঘোর পরিবর্তন দেখতে পায় পারুল। কেমন খিদে ফুটে থাকে মুখে, চোখের দৃষ্টি সরু হয়ে আসে। কামুক পুরুষের দৃষ্টি চিনতে মেয়েদের কোনও অভিজ্ঞতার দরকার হয় না। তারা ও ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়। পারুল নির্ভুল বুঝতে পেরেছিল, অমল যে কোনও দিন তাকে চাইবে। আর তখনই একটু ভয় হয়েছিল তার।
একদিন এক প্রচণ্ড গরমের দুপুরে অমল উদভ্রান্তের মতো এসে হাজির। পারুল তার দোতলার পড়ার ঘরে নিরিবিলি বসে পরীক্ষার পড়া করছিল। অমলের চেহারা দেখে সে শিউরে উঠেছিল। মাথায় বড় বড় চুল উড়ছে, মুখখানা রোদে পুড়ে লাল, আর দুখানা চোখে ধক ধক করছে এমন একটা দৃষ্টি যা বুঝতে কোনও মানে-বইয়ের দরকার হয় না।
অমলদা, কী হয়েছে?
অমল হাঁফাচ্ছিল। এত জোরে হেঁটে এসেছে, এত উদভ্রান্ত, এতই দেহতাড়িত যে সে আর স্বাভাবিক নেই। চাপা গলায় সে বলল, পারুল আমি আর পারছি না।
পারুল প্রবল আতঙ্কে সিঁটিয়ে গিয়ে বলে, কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।
বুঝতে হবে না, শুধু চুপ করে থেকো।
প্রবল এক পুরুষ শরীর, সেই শরীরের ঘাম, উত্তাপ, আবেগ, আশ্লেষ আচমকা আক্রমণ করেছিল তাকে। সে শুধু চাপা চিৎকার করেছিল, না না না না
দরজাটা বন্ধ করতেও ভুলে গিয়েছিল অমল। তখন সে উন্মাদ, কাণ্ডজ্ঞানহীন। কাম ছাড়া তখন আর তার কোনও অনুভূতিই কাজ করছে না।
সে এক তুমুল লড়াই হয়েছিল দুজনের মধ্যে। আক্রমণ আর প্রতিরোধ। আর তার ভিতর থেকেই পারুলের মনে জন্ম নিচ্ছিল ঘৃণা।
বিধ্বস্ত পারুলকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল অমল। অনুতাপ হয়েছিল পরে।
পারুল তবু ক্ষমা করে দিতে পারত অমলকে। নিশ্চয়ই পারত। ভালবাসলে ওটুকু পারাই যায়। জোর একটা ধাক্কা খেয়ে হয়তো মানুষটা সম্পর্কে তার ধারণা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন তার সতেরো বছর বয়স, ও বয়সের আবেগ অনেক কিছুকে উপেক্ষা করতে পারে। তার ওপর সেই দুপুরের দুর্ঘটনায় সে যদি মা হয়ে পড়ত তাহলে অমলকে ক্ষমা করা ছাড়া তার উপায়ও থাকত না।
পরদিন সকালে শান্ত ভদ্র অমল লাজুক মুখে এসে হাজির।
ইস। কাল কী কাণ্ডই না করে ফেললাম পারুল।
পারুল সারা রাত কেঁদেছিল, ঘুমোয়নি, রাতে খায়ওনি। শরীর ভীষণ খারাপ লাগছিল সকালে। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, কেন করলে এরকম? বিয়ের আগে কেউ ওসব করে? ছিঃ ছিঃ, এখন কী যে হবে।
ভয় পেও না।
ভয় পাব না? তুমি পুরুষমানুষ বলে কত সহজে কথাটা বলে ফেললে। মেয়ে হলে পারতে না। সব দায় তো মেয়েদেরই বইতে হয়। তাদের নামেই নিন্দে হয়, তাদেরই জীবনভর কলঙ্ক থেকে যায়। বাচ্চা নষ্ট করতে গিয়ে তারাই তো মরে।
ওভাবে ভাবছ কেন? প্রেগন্যান্সির লক্ষণ দেখলে বোলো, বিয়ের ব্যবস্থা করব।
সেটাই বুঝি খুব সহজ সমাধান? সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। প্রেগন্যান্সি হলে বাড়ির সবাই টের পাবে। ফিসফাস হবে, লোক জানাজানি হবে। অমলদা, তুমি আমার খুব ক্ষতি করলে। তোমার কথা ভাবলেই আমার ভিতরে একটা আলো জ্বলে উঠত। সেই আলোটা নিবে গেছে। আর জ্বলবে না।
কী করব পারুল, তোমার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব?
না, ক্ষমা চাইবে কেন? ক্ষমা চাইতে হয় কেন তোমাকে? একটু ধৈর্য ধরে রাখতে পারলে না কেন?
অপরাধী মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল অমল। তারপর বলল, আমি মাঝে মাঝে বড্ড বেসামাল হয়ে পড়ি। কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে সামলাতে। পারিনি। এমন পাগল হয়ে যাই তখন যে মাথায় খুন চেপে যায়। এ ব্যাপারে আমি এত হেলপলেস। ভাবছি ডাক্তার দেখাব। এ বোধহয় কোনও ডিজিজ।
তুমি যদি আমাকে ভালই বাসো তা হলে রেপ করো কী করে? এরকম কি কেউ করে?
যা হয়েছে হয়েই তো গেছে। কিছুতেই তো আর সেটাকে মুছে ফেলা যাবে না। বরং পজিটিভ কিছু ভাবি এসো।
না অমলদা, আমার মাথার ঠিক নেই। ভয়ে আতঙ্কে আমি মরে যাচ্ছি। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। এ বাড়িতে এরকম ঘটনা আর কারও ঘটেনি। বিয়ের আগে– এ মা।
অমল মিনমিন করে ফের বলল, আমাদের বিয়ে তো হবেই। তখন তো আর এসব দুশ্চিন্তা থাকবে না।
থাকবে। তোমাকে নিয়ে আমার ভয় থাকবে। তোমার সংযম নেই, তুমি বেহাল হয়ে যাও, মেয়েরা তাদের পুরুষকে ওরকম দেখতে ভালবাসে না।
আমার মনে হয় এটা আমার একটা অসুখ। চিকিৎসা করালে নিশ্চয়ই সেরে যাবে।
এসব কথায় বুকের জ্বালাপোড়া একটুও কমল না পারুলের। তার ভিতরটাই যেন হঠাৎ মরে গেছে। ভালবাসা যেন খোঁটা উপড়ে পালিয়ে গেছে কোথায়। শুধু এক জৈব ভয় তাকে দিনরাত নখে দাঁতে ছিঁড়ে খাচ্ছে। শরীর যে তাদের মধ্যে এমন দেওয়াল তুলে দেবে কে জানত।