দিনের বেলা অফিস, মিটিং, নতুন স্কুলের জন্য ছোটাছুটি, জুড়ান সেই আয়ার হেফাজতে। রাতে সারাদিনে ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসে, তখন ঘুম থেকে উঠে কাঁথা পালটানো বা দুধ খাওয়ানোর শক্তিও থাকে না তার। তাই জুড়ানও অন্য দুই ছেলেমেয়ের মতোই আয়াকে মায়ের চেয়ে বেশি চিনেছে।
সন্তানদের একশো পারসেন্ট মা হওয়া আর হল না তার। ছেলেমেয়েরা অতি সৎ ভব্য, কেতাদুরস্ত, মায়ের সঙ্গে তারা সবসময়েই সৌজন্যমূলক আচরণ করে। কোনও বেয়াদপি করে না কখনও, আর সেটাই তার বুক থেকে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস টেনে বের করে।
একা বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ এইসব ভাবল পারুল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
এঃ পারুল, তোমার ফ্যাট হয়ে যাচ্ছে! কথাটা সারা রাত ঘুমের মধ্যেও ক্রিয়া করল পারুলের মনে। অভ্যাসবশে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কথাটা মনে হল তার, একটু জগিং করা দরকার। তারপর কিছু স্ট্রেচ আর ফ্রি হ্যান্ড। জামশেদপুরে তার অনেক ব্যায়ামের যন্ত্রপতি পড়ে আছে। কতকাল ছোঁয়া হয়নি সেগুলো।
সে উঠে পড়ল। বাথরুম সেরে এসে সে ট্রাকসুট পরে নিল। পায়ে গলাল স্লিপার। ঠিক বটে, গাঁয়ের রাস্তায় ট্রাকসুট পরে দৌড়লে লোকে অবাক হবে। তোক গে। গেঁয়ো ভূতেদের জন্য নিজেকে গুটিয়ে রাখার মানে হয় না। সেই যে মেয়েদের কত বড় শত্রু তা সে খুব ভাল জানে। থপথপে, পেটমোটা, কিম্ভুতকিমাকার হওয়ার চেয়ে বরং মরা ভাল।
স্নিগ্ধ ভোরের আবছা আলোয় সে বেরিয়ে পড়ল।
নির্জন রাস্তায় সে তার পায়ের টুপটাপ শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল। না, এখন সে আর আগের মতো হালকাপলকা নেই। শরীরের অনেক টিলা অংশ দৌড়ের তালে লাফাচ্ছে, বিশেষ করে পেট, বুক, নিতম্ব। হাঁফ ধরছে, ঘাম হচ্ছে।
গাঁয়ে আর আগেকার মতো ফাঁকা ফাঁকা ভাবটা নেই। কত বাড়িঘর উঠে গেছে। ভরাট হয়েছে কত শূন্যতা, বসত বাড়ছে, তোক বাড়ছে, এখন গাঁয়ে স্পষ্টই শহরের আদল।
ছুটতে ছুটতে রাস্তা ছেড়ে পোড়ো একটা জমি আড়াআড়ি পার হচ্ছিল সে। একটা আল। আলের ওপর সরু রাস্তা ধরে ছুটছিল সে।
আচমকাই–তাকে চমকে দিয়ে আলের পাশ থেকে চাবুকের মতো মাথা তুলল লেলিহান একটা প্রকাণ্ড সাপ।
পারুল শিহরিত হয়ে থেমে গেল, ভয়ে চিৎকার করতে গিয়ে হাঁ করে সে টের পেল গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। তার হাত পায়ে শীতল শিথিলতা, নড়তে পারছে না পারুল। মাত্র কয়েক ফুট দূরে পারুলের কোমর সমান উঁচু ফণা তুলে আছে সাপ। পুব আকাশের সিঁদুরে আভায় লকলক করছে, ঝলসাচ্ছে মৃত্যুদূত। শিকড়-বাকড়ের মতো তার কালো চেরা জিব বারবার চেটে নিচ্ছে শূন্যতা।
বিহ্বল, অবশ পারুলের চোখে চোখ রেখে তাকে সম্পূর্ণ সম্মোহিত করে ফেলেছে সাপ। পারুল টের পাচ্ছে, তার আর কিচ্ছুটি করার নেই। সে চোখ সরাতে পারছে না, তার পলক পড়ছে না, হাতে পায়ে সাড় নেই। সাপটা এখন এগিয়ে এসে যদি ছোবল দেয়, পারুলকে বিনা প্রতিরোধে ছোবলটা খেতেই হবে। এত অসহায় নিজেকে কখনও লাগেনি তার। বহু বছর আগে আর একটি সাপ তাকে খেয়েছিল বটে, সে ছিল মানুষ সাপ। তার বিষে জর্জরিত পারুলের মন থেকে বিশ্বাস, প্রেম, নির্ভরতা সব ঝুরঝুর করে সরে গিয়েছিল। আবাল্য প্রণয়ে বিষ ঢেলে দিয়েছিল অমল। সেই বিষে এক পারুল মরল, এক অমলও মরল।
আজ জীবনের আর এক লগ্ন। সামনে কালসাপ ফণা তুলে তার অমোঘ সম্মোহনে আচ্ছন্ন করে ফেলছে পারুলকে। পারুলের দু চোখে জল, তার মন অসংলগ্ন এক সংলাপ বলে যাচ্ছে, আমাকে কামড়াবে তুমি? কেন কামড়াবে বলল। দেখ, আমার মতো রূপ তুমি দেখেছ কখনও? এত রূপ নষ্ট করে দেবে? জানো আমার জীবন কত সুন্দর, কত সুখ আমার! সব নষ্ট করে দেবে? আমার কত কাজ পড়ে আছে, সব যে ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আমার ছেলেমেয়েরা আর মা বলে ডাকবে না! তুমি কি জানো, আমার জুড়ান এখনও মা বলে চেনেনি আমাকে! আমাকে ভিক্ষা দাও আয়ু। আমাকে মেরো না। মেরো না…।
আজ এই ভোরে আলের ওপর চিকণ শরীরে দাঁড়িয়ে সম্মোহিত পারুল টের পেল, তার অস্তিত্ব থেকে ঝরে যাচ্ছে রূপ, যৌবন, সুখ, তার চালচিত্রে ঐশ্বর্যের পেখম গুটিয়ে নেতিয়ে পড়ে গেল। সে কাঁদছে, বাচ্চা একটা অবোধ মেয়ের মতো কেঁদে যাচ্ছে সে।
বিস্ফোরক কয়েকটি মুহূর্ত কেটে যাওয়ার পর সাপটা একটা তাচ্ছিল্যের শাস ফেলে টেলিস্কোপের মতো ফণা নামিয়ে নিল। তারপর পোডো জমিটার ভিতরে ঝোপজঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল চোখের পলকে।
না, পারুল পালাল না, সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে নতজানু হয়ে বসল আলের ওপর। সাপের কাছ থেকে ভিক্ষালব্ধ প্রাণ, তুচ্ছ আয়ু যেন কাঙালিনীর মতো কুড়িয়ে নিল সে। সে বুঝতে পারল, কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যে তাকে দুমড়ে, মুচড়ে নিংড়ে নিঃশেষ করে দিয়ে গেছে সাপটা, সে ফিসফিস করে বলল, আই অ্যাম নো গডেস, আই ওয়াজ নেভার এ গডেস, ওঃ গড।
কতক্ষণ বসেছিল তার হিসেব নেই, চোখে রোদ পড়ল, মাঠঘাট পরিদৃশ্যমান হল, চারদিকে সমবেত জাগরণের নানা শব্দ, ধীরে সংবিত ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়াল পারুল। চোখ মুছল। তারপর ফিরে এল বাড়িতে।
না, কারও কাছেই সে সাপের গল্পটা বলল না, যতদিন বাঁচবে ততদিন কারও কাছেই কখনও বলবে না। এ তো কোনও গৌরবগাথা নয়। এ তার এক পরাভবের গল্প। আজ ভিখারিণীর মতো লাগছে নিজেকে। অন্য রকম, যেন সে নয়।