ভাঙা চাঁদ যে সোনার গুঁড়ো নির্জন নিশুতি রাতে মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দিচ্ছিল চরাচরে সেই হিরন্ময় আবছায়ায় এক প্রকাণ্ড মেঠো ইঁদুরকে সে পেয়ে গেল তার হাতে। সে জানে, শুধু সে-ই জানে কী প্রাণান্তকর খাদ্যের সঙ্গে তার এই নিজস্ব লড়াই। খুব ধীরে এক ক্লেশকর প্রক্রিয়ায় সে গিলতে থাকে ইঁদুরটাকে। শরীরের সবটুকু শক্তি ও প্রয়াস দিয়ে, বড় ক্লান্ত লাগে তার, বড় পরিশ্রান্ত।
এই নিশুত রাতে কত কীট ও পতঙ্গ জেগে আছে চারদিকে। কত চোখ জ্বলছে নিবছে। খাদ্য ও খাদকের এই নিষ্ঠুর জগতে ক্ষুধা নিদ্রাহীন। রাতচরা পাখিরা অন্ধকার ডানায় ভর করে চক্কর দিচ্ছে ওপরে। মাটির অন্দরে অন্দরে চলেছে ক্ষুদ্রকায় জীবদের অন্তহীন চলাফেরা, বিষয়কৰ্ম। জেগে আছে পিঁপড়ে, ডাঁশ, জোনাকি। মেঠো ইঁদুরটাকে গিলে সে তার দীঘল শরীরে নিশ্চুপ প্রলম্বিত হয়ে থাকে আলের পাশে। চারদিকে হিরন্ময় আবছায়ায় সে এই জাগ্রত জগৎকে টের পায়।
.
কখনও এরকম হয়, সারাদিন ধরে মনটা যেন একটু খারাপ হয়ে থাকে। কারণটা বোঝা যায় না, অনেক ভাবলে, ভাবতে ভাবতে হয়তো মনে পড়ে যায়, কারও একটা আলাদা কথা, একটা রূঢ় চাউনি, একটু শীতল ব্যবহার বা ওইরকম তুচ্ছ কিছু। তুচ্ছ, তবু সারাদিন জেদি মাছির মতো উড়ে উড়ে এসে মনের ওপর বসে থাকে, কিংবা শরীরের দুরূহ খাঁজে লুকিয়ে থাকা লাল পিঁপড়ের মতো কুটুস কুটুস করে কামড়ায়। পারুল বড় জ্বালাতন হল।
অথচ মন খারাপের যেটা সবচেয়ে বড় কারণ অর্থাৎ মায়ের অসুখ, সেটা তেমন গুরুতর নয় বলে জানা গেছে। গতকাল যখন জামশেদপুর থেকে নতুন টয়েটো গাড়িটায় আসছিল তখন কী টেনশন! জ্যোতিপ্রকাশ তাকে বলে দিয়েছিল, তুমি টেনশন নিয়ে যাচ্ছ, সাবধান, ড্রাইভ কোরো না কিন্তু। বরের কথাটা রাখেনি পারুল। দুপুরের দিকে ধাবায় নেমে লাঞ্চ করে আসার পর তার ড্রাইভারের বারবার ঢুলুনি এসে যাচ্ছিল বলে পারুল বলল, তুমি পাশের সিটে বসে একটু ঘুমিয়ে নাও, নইলে অ্যাকসিডেন্ট করবে। ততক্ষণ আমি চালাচ্ছি। ড্রাইভার অবশ্য বলেছিল জাপান বা গুটকা খেলেই ঘুম উড়ে যাবে। পারুল রিস্ক নেয়নি।
অনেকটাই ড্রাইভ করেছে পারুল। এক মুহূর্ত সময় যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য। সন্ধেবেলা এসে পৌঁছে দেখল, বাড়ি ভর্তি লোকজন জড়ো হয়েছে। দাদারা, বউদিরা, ছেলেমেয়েরা, তবে মা ভাল আছে। শরীর দুর্বল, তবে সিরিয়াস কিছু নয়। তাকে দেখে বলাকা হেসে বলল, হ্যাঁ মা, তুই নাকি অনেক কাজ ফেলে এসেছিস।
হ্যাঁ মা, কিন্তু তোমার চেয়ে তো কাজ বড় নয়।
বিজু বকছিল আমাকে। বলল, জানো পারুলদি এখন কী রকম ভি আই পি হয়ে গেছে? কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ওদের। হুট করে আসতে পারে নাকি?
পারুলরা যে সাংঘাতিক বড়লোক হয়ে গেছে এটা সকলের মুখেই ঘুরেফিরে শুনতে পাচ্ছিল পারুল। বিনয়ের সঙ্গে অস্বীকার করছিল বটে, কিন্তু কথাটা তো আর মিথ্যে নয়। তারা এখন সত্যিই বড়লোক। বড়লোক আর ব্যস্ত লোক। এই বড়লোক হওয়ার পিছনে তার অবদানও খুব কম নেই। সে এখন ব্যবসা বোঝে, কারখানা তিনটের অন্ধিসন্ধি জানে, বাজার অর্থনীতির সব খবর রাখে। খুব শিগগিরই জ্যোতিপ্রকাশ তাকে বিজনেস টুরে দিল্লি বোম্বে পাঠাবে। ফিনান্সিয়াল ইয়ারের পর তাদের ইউরোপেও যাওয়ার কথা। আপাতত তার দম ফেলার সত্যিই সময় নেই। তার ল্যাপটপ কম্পিউটারে জমা কত যে তথ্য। এই যে সে মায়ের কাছে এল, নিজেকে ছিঁড়ে আনতে হল কত দায়দায়িত্ব থেকে!
তবে এসে খারাপও লাগছে না তার। যেন একটা পারিবারিক গেট টুগেদার। অসুখ গুরুতর নয় বলে দিব্যি আড্ডাও হচ্ছিল তাদের।
রাত্রিবেলা যখন ল্যাপটপ নিয়ে বসে হিসেবপত্র করছিল তখনই হঠাৎ মন খারাপটা টের পেল। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কেন খারাপ। কী এমন হয়েছে এর মধ্যে? বারবার কাজের মধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সে। ভ্রূ কুঁচকে ভাবছিল। কেন, কেন মনটা খারাপ রয়েছে?
অনেকক্ষণ ভাববার পর হঠাৎ চাবুকের মতো মনে পড়ে গেল কথাটা। বড়বউদি আজ তাকে দেখেই বলেছিল, এঃ পারুল, তোমার বেশ ফ্যাট হয়েছে।
হ্যাঁ, ওই কথাটাই। ওটাই তার মন খারাপের কারণ।
আর কারণটা মিথ্যেও নয়। সে নিজেও টের পাচ্ছে, ছেলে হওয়ার পর থেকেই তার শরীরের বাঁধন কিছু আলগা হয়েছে। ব্যবসার কাজে বেশি সময় দিতে গিয়ে কমে গেছে রোজকার ব্যায়াম। খাওয়াও হচ্ছে কিছু উলটোপালটা।
কিছুদিন আগেই জামশেদপুরের একজন পরিচিত বিউটিশিয়ান মেয়ে তাকে বলেছিল, মিসেস গাঙ্গুলি, মুখের মাসাজ করান। আপনার প্রোফাইলের শার্পনেস কমে যাচ্ছে।
খুব দুশ্চিন্তার হয়তো কিছুই নয়। কিন্তু মন কি সব কিছু মেনে নিতে চায়? তিন বারের মাতৃত্ব তার খাজনা নিয়েছে, খাজনা নিচ্ছে বয়স, খাজনা দিতে হচ্ছে ব্যবসার জন্য। অত্যধিক মানসিক টেনশন এবং শরীরকে না খাটানোর জন্য।
কিন্তু সকলের ওপরে হল বয়স।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপে মনোযোগ দিতে যাচ্ছিল সে। খেয়াল হল রাত একটা বাজে। ব্যস্ততার সময়ে শরীরের ক্লান্তিও টের পাওয়া যায় না। নইলে যা জার্নি করেছে তাতে এতক্ষণ ঘুমে ঢুলে পড়ার কথা।
তার স্থির করা ছিল, ছোট ছেলেটাকে নিজের হাতে মানুষ করবে। ওর সবকিছু নিজেই করবে সে। বড় দুটোকে সময় দেয়নি, ওরা আয়ার কাছে মানুষ বলে তেমন যেন আপনও হয়নি তার। সূক্ষ্ম দূরত্ব রয়ে গেছে যেন একটু। ভেবেছিল ছোটটার বেলায় পুষিয়ে দেবে। আদর করে ওর নাম রেখেছে জুড়ান। তাকে জুড়িয়ে দেবে। কিন্তু ঘটনা সেরকম ঘটল না। সারাদিন পরিশ্রমের পর আর পারে না সে।