কানে কি ময়দা গুঁজে আছিস তোরা? শুনতে পাস না? এমন যোগ আর পাবি? সাপের শঙ্খ লেগেছে এদিককার বাগানে। একটা নতুন কাপড় নিয়ে আয় শিগগির।
ও মা! বলে মুক্তা ঘরে এসে বলল, একটা নতুন কাপড় দাও তো! সাপের শঙ্খ লেগেছে বলছে।
ওই আলমারিতে আছে, নিয়ে যা।
মুক্তা কাপড় বের করে নিয়ে যাচ্ছিল, বাসন্তী বলল, বেশি কাছে যাসনি। কামড়ে কামড়ে দেবে। এ সময়টায় ওদের বিরক্ত করতে নেই কিন্তু।
জানি বাবা, জানি। তুমি শুয়ে থাকো তো।
মুক্তা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বাসন্তী উঠল। শরীর ভাল নেই। তার চেয়েও খারাপ তার মন। সেদিন যে সিঁড়ি থেকে পড়ে যাচ্ছিল সেই থেকে ভয় খামচে ধরে আছে বুক। পেটেরটা নষ্ট হয়ে যাবে না তো!
বারান্দায় এসে রেলিঙে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছিল বাসন্তী। কিন্তু ওদিকে জিজিবুড়ির ঘর আর উত্তর দিকের দালানের ফাঁকটায় কলার ঝাড় হওয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জিজিবুড়ি আর মুক্তাকেও না।
সবসময়ে আজকাল তার বড্ড ভয় হয়। সব ব্যাপারেই ভয়। বছর তিনেক আগে শঙ্খ লাগা দুটো সাপকে ঢিল দিয়ে মেরে ফেলেছিল মরণ। বড্ড দস্যি ছেলে। খুব রাগ করেছিল বাসন্তী।
মারলি কেন রে যমদূত? মা মনসার বাহনকে কি মারতে আছে?
বড় করে মনসাপুজো করিয়ে মা মনসার কাছে অনেক মাথা কুটেছিল বাসন্তী, অবোধ ছেলে মা, ভুল করে তোমার বাহনকে মেরেছে। ক্ষমা করে দাও মা।
কিন্তু ওই দুরন্ত ছেলে কি কথা শোনে? বাপ ছাড়া কাউকে ডরায় না। তার পরও কতবার সাপ মেরেছে তার হিসেব নেই। এর ওর তার মুখে খবর পায় বাসন্তী। ছেলের ওপর রাগ করে, তারপর কাঁদে, তারপর ঠাকুর-দেবতার পায়ে মাথা খোঁড়ে। ওই যে মরণ গাছে ওঠে, পাখি কি ফড়িং মারে এসবই বাসন্তীকে ভারী ভয় খাইয়ে দেয়। পাপ হচ্ছে ছেলেটার, অধর্ম হচ্ছে, ভগবান যদি শাস্তি দেয়।
এভাবে মাকে কাঁদিয়ে, ভাবিয়েই এখন একটু বড় হয়েছে মরণ। বোনের দাদা হয়েছে, এখন হাতপায়ের চঞ্চলতা একটু কমেছে, দস্যিপনায় একটু ভাঁটার লক্ষণ। তবু সর্বদা কাঁটা হয়ে আছে বাসন্তী। ছেলেপুলে মানেই তো দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, ভয়, উদ্বেগ। এই যে বড় হচ্ছে হাম্মি, কম উৎকণ্ঠা ওকে নিয়ে! কখন পড়ে, কখন ব্যথা পায়, কখন কাঁদতে গিয়ে টাগ ধরে দম আটকায়। তার ওপর আর একজন এসেছেন পেটে। এখনই পেটের মধ্যে তার খলবলানি টের পায় বাসন্তী। ইনিও জানান দিচ্ছেন, কম দুটি হবেন না জন্মানোর পর। খলবলানি থেকেই টের পায় বাসন্তী।
সিঁড়ি থেকে যেদিন পড়ে গেল তার পর পুরো একটা দিন বাচ্চাটা পেটের মধ্যে নড়েনি মোটে। কী ভয়ই যে পেয়েছিল সে! রসিক গিয়ে অনল ডাক্তারকে ডেকে আনল পরদিন সন্ধেবেলা। ডাক্তার নল লাগিয়ে কী যেন দেখে-টেখে বলল, মনে হয় বাচ্চা ঠিকই আছে। তবু একবার গায়নোকোলজিস্ট দেখিয়ে নিন।
তা আর দেখাতে হয়নি। একদিন চুপ থাকার পর দুটা আবার দ্বিগুণ তেজে হাত-পা নাড়ছে, পাশ ফিরছে মায়ের পেটের মধ্যে।
রসিক বলে রেখেছে এইবার তোমার পোলা হইব। তা তাই হবে বোধহয়। ছেলে হলে বাসন্তীর আরও দুশ্চিন্তা বাড়বে। মেয়েদের তবু হাতে পায়ে দামালপনা নেই, তেমন হার্মাদও হয় না তারা। কিন্তু ছেলে হলে, বাসন্তী জানে, সে হবে মরণেরই দোসর। এইসব আগাম ভেবে তার সর্বদা বুক দুরদুর করে।
বাগানের দিক থেকে শাড়ি হাতে উঠোনে ঢুকে মুক্তা চেঁচিয়ে বলল, ওরেব্বাস! কী বড় বড় দুটো সাপ গো বউদি!
কী সাপ রে?
মাথায় খড়ম, সাক্ষাৎ গোখরো। তোমার নতুন শাড়িতে খুব গড়াগড়ি খেয়েছে দুজন।
ঘরেদোরে আসবে না তো!
না। ওদিক পানে চলে গেছে।
মরণের বাবা আবার ওখানেই রোজ সকালে কাককে রুটি খাওয়াতে যায়। একটু সাবধান করে দিতে হবে।
পৃথিবীটা যে কেন এত ভয়ভীতিতে ভরা কে জানে বাবা। একটা দিনও বাসন্তী নির্ভাবনায় কাটাতে পারে না।
আর ওই যে সম্পর্কের একটা কাঁটা বিঁধে আছে বুকে তাই থেকে সর্বক্ষণ কিছু কিছু রক্তক্ষরণ হয়। কে জানে বড়বউয়েরও তাই হয় কি না। দুজনে কি দুজনের মরণ চায়? না, না, ছিঃ ছিঃ, সে আর ভাববে না ওরকম। বড়বউয়ের একশো বছর পরমায়ু হোক।
শঙ্খ লাগা কাপড়টা এনে তার হাতে দিয়ে মুক্তা বলল, রেখে দাও যত্ন করে। দেখবে ঘরদোরে মা লক্ষ্মী উপচে পড়ছে।
কাপড়টা ফিরিয়ে দিয়ে বাসন্তী বলল, যত্ন করে ভাঁজ কর, তারপর আলমারির ওপরের তাকে রেখে দিগে যা।
শনিবার রাতে এক মধুর রতিক্রিয়ার পর সে যখন তার বরের গলা জড়িয়ে নিবিড় হয়ে শুয়েছে তখনও তার মনে হচ্ছিল, এত মাখামাখি, এত কাছাকাছির পরও কেউ আপন না হয়ে পারে?
গাঢ় স্বরে সে বলল, তুমি কাছে থাকলে আমার মনটা বড় ভাল থাকে। একটুও ভয় করে না, তুমি চলে গেলেই কেমন যেন হয়ে যাই।
রসিক তার সবল হাতে নিজের মেয়েমানুষটিকে আগলে ধরে বলল, এত ডরাও ক্যান? দুনিয়াটারে ক্যাজুয়েলি লইতে পার না?
সেটা কী গো?
সবসময় ভাববা দুনিয়ায় কেডা কার। চক্ষু বুজলেই কে কোনখানে যামু গিয়া তার কি কিছু ঠিক আছে?
এ কথায় কেঁপে উঠে রসিককে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা ঘষে সে। না না, তারা কেউ কোথাও যাবে না। এক বিশাল অচেনা অন্ধকার মহাবিশ্বে তারা কেউ কখনও ছিটকে যাবে না পরস্পরের কাছ থেকে। মরলেও ফের এই বর, এই ছেলে মেয়ে এদের ঠিক ফিরে ফিরে পাবে সে। পাবেই। না পেলে যে পাগল হয়ে যাবে। অস্ফুট স্বরে আকুল হয়ে সে বলে, আর বোলো না, আর কক্ষনও বোলো না ওরকম…