বলাকা হাসে, চলে আর যেতে পারছি কই? দেখছেন না, ডাক্তার বদ্যি, ওষুধপত্রে বাড়ি ভরে গেল। ডাক্তার বলে গেল, ভয়ের নাকি কিছু নেই। ওরা তো বোঝে না, চলে যাওয়াটা মোটেই ভয়ের ব্যাপার নয়।
আপনার যে ইচ্ছামৃত্যু বউঠান। শরীরে মনে যাদের পাপ নেই তারা যেদিন ইচ্ছে দেহ ছাড়তে পারে। আমাদের মতো পাপীতাপীদেরই নানা ভোগান্তি।
ওসব বলবেন না ঠাকুরপো, মরার কথা ভাবেন কেন?
ও আপনিও ভাববেন না, আপনি চলে গেলে, আমার মনে হয়, গাঁয়ের লক্ষ্মীই চলে যাবে। আপনি নমস্যা।
আমাকে আর পাপের তলায় ফেলবেন না ঠাকুরপো, পায়ে পড়ি, সম্পর্কে বড় হলেও আমি বয়সে আপনার ছোট, মনে রাখবেন।
মহিম মলিন হেসে বলে, বয়সটাই হল, আর কিছু হল না। গৌরদা গিয়ে অবধি বড় কাহিল হয়ে পড়েছি। আপনি গেলে যে সব যাবে।
মহিম চোখের জল মোছে। এ তার মন-ভোলানো কথা নয়। মনে মনে সে এই মহীয়সী নারীকে এই গাঁয়ের লক্ষ্মী বলেই ভেবে এসেছে। গৌরহরিকে বলেছেও সে কথা। গৌরহরি শুধু হাসত। সেই হাসির মধ্যে একটা উজ্জ্বল তৃপ্তি ফুটে উঠত। যেন প্রাইজ জেতার আনন্দ।
টর্চের ব্যাটারিটা বড্ড কমজোরি হয়ে গেছে, বদলাতে হবে। নিবু নিবু আলোয় পথ ঠাহর করে ফিরছিল মহিম। মনটা ভার। বউঠানের অসুখ-টসুখ শোনেনি কখনও। বলতে গেলে এই প্রথম। কিন্তু শরীর কি সিগন্যাল দিচ্ছে? বউঠান চলে গেলে একটা যুগই শেষ হয়ে যাবে যেন।
কাঞ্জিলালের জমিটার কাছ বরাবর রাস্তায় একটা আড়াআড়ি খাঁজ। একটা নালার মতো। টর্চের আলোটা ভাল পড়েনি সেখানে। আনমনে পা বাড়িয়েও হঠাৎ কী যেন মনে হল মহিমের। কে যেন টেনে ধরল পিছন থেকে। টর্চের বাতি আরও ক্ষীণ হয়েছে। চোখের জোরও তো কমে গেছে অনেক। শূন্যে বাড়ানো পা টেনে নিল মহিম। তারপর দেখতে পেল।
বিশাল লম্বা চিত্রিত একটা শরীর খুব ধীরে ধীরে রাস্তাটা পেরিয়ে যাচ্ছে। টর্চটা ধরে রইল মহিম। সাপটা অনেকক্ষণ ধরে রাস্তাটা পার হল।
চিন্তিত মহিম আবার হাঁটতে লাগল। এই রাতের অন্ধকারে সাপটা যে কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে কে জানে।
নিজেও সে জানে না। আলো আর অন্ধকার কোনওটাই তার প্রিয় নয়। সে শুধু এক অনির্দিষ্ট নির্দেশেই চলে। কখনও থামে, চারদিকটা ঠাহর করার চেষ্টা করে। সে ভয় পায়। এই পৃথিবীতে তার বসবাস কখনওই নিরাপদ নয়।
অন্ধকার মাঠের মধ্যে সাপটা একটু থামল। শরীরে একটা চলবলে ভাব। খোলস ছেড়ে যাচ্ছে দেহ। একটা ইটের পাঁজার শ্যাওলা ধরা খাঁজে সে প্রবাহিত করে দেয় নিজেকে। ইটের খাঁজে খাঁজে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার অনুভূতি। তবু সে নিজেকে প্রবাহিত রাখে। খাঁজে খাঁজে আটকে যায় তার আলগা খোলস। শরীরে নির্মোক খসে যেতে থাকে। সিরসির করে তার নতুন ত্বক। ধীরে ধীরে দীর্ঘ একটা মোজার মতো নিজের খোলসটি ছেড়ে সে বেরিয়ে আসে।
না, তার কোনও স্থায়ী গৃহ নেই, ঠিকানা নেই, গৃহিণী বা সংসারও নেই। সে একা, সে অসুখী। সে প্রবহমান এক অনন্ত একাকিত্ব।
তার হৃদয় নেই, প্রেম নেই। তবু বীজ বপনের অস্থিরতা আছে। শরীরে সেই চঞ্চলতা টের পায় সে। বারংবার সে শ্বাসবায়ু ত্যাগ করে। ক্ষীণ চোখে, ত্বকে, তার অস্পষ্ট ঘ্রাণশক্তি দিয়ে সে নারীগন্ধ খোঁজে। তার বিবাহের সময় এল। শরীরে অনাগত সন্তানের কোলাহল। সে সংবরণ জানে না। তার নারীশরীর চাই।
সে তাই খোঁজে। সর্পিল শরীরে কত খানাখন্দ, কত গহ্বর কন্দরে সে তার পিছল কামার্ত শরীর প্রবাহিত করে দেয়।
যখন চড়া রোদে ধুধু করছে মাঠঘাট, সে একটা বিশুষ্ক নালা পার হয়ে নিবিড় এক ঘাসজমির ভিতরে অকস্মাৎ দেখা পেল তার। নির্ভুল নারীগন্ধ পেয়ে গেল সে।
পূর্বরাগ ছিল না, ভূমিকাও নয়, তারা উভয়েই উত্তোলিত ফণায় মুখোমুখি হল। চোখে চোখ। নর ও নারী। তার পর মুহূর্তেই তীব্র ছোবল এসে পড়ল তার শরীরে। সে এই মুদ্রা চেনে। পালটা ছোবলে সে তার মহিলাকে আক্রমণ করে। ভাষাহীন, ভাবাসাহীন তাদের এই আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণের ভিতরেই লুকোনো ইচ্ছা বেরিয়ে আসে যেন। তোমাকে চাই। ছোবলে ছোবলে চুম্বন নেই, কিন্তু আসঙ্গ আছে। আর ওই আক্রমণের ভিতরেই পাক খেয়ে জড়িয়ে যায় দুটো বাহুহীন শরীর। কাছাকাছি দুটি মুখে কোনও রূপতৃষ্ণা নেই, পছন্দ অপছন্দ নেই, নেই প্রিয় ফিসফাস। শুধু প্রয়োজন, শুধু মোক্ষণ। রতিক্রিয়া কোনও উপভোগ্য কাজ নয় তার কাছে। এ যেন শরীরের এক বাধ্যতামূলক নির্দেশ মাত্র। সে তার বীজের ভূমি খুঁজে পেল আজ দ্বিপ্রহরে। মাত্র এটুকুই।
ওরে শঙ্খ লেগেছে! শঙ্খ লেগেছে। একটা নতুন কাপড় নিয়ে আয়। ফেলে দে এ দুটোর ওপরে।
জিজিবুড়ির চিৎকার শুনে দোতলায় চমকে উঠল বাসন্তী।
ও মুক্তা, দ্যাখ তো, মা চেঁচায় কেন।
মুক্তা পা ছড়িয়ে বসে একটা কাঁথায় ফোঁড় তুলছিল। নতুন মানুষ আসছে এ-সংসারে কত কাঁথাকানি লাগবে। ঠোঁট উলটে বলল, সারাদিনই তো চেঁচায়, বোধহয় ঘরে ভাম-টাম ঢুকেছে।
তবু দ্যাখ ভাই। ও ঘরে বিছে-টিছে আছে। কামড়াল কি না দ্যাখ।
সে বিছে এখনও জন্মায়নি। কামড়ালে নিজেই মরবে। আফিং-খাওয়া শরীর বাপু, ওকে কামড়ালে রক্ষে আছে?
তোর ওই দোষ। কেবল ফুট কাটিস।
দেখছি বাবা, দেখছি।
মুক্তা উঠে এসে দোতলার রেলিং দিয়ে ঝুঁকে বলল, হয়েছে কী? চেঁচাচ্ছ কেন?