পারুল ফোন কেটে দিল।
সোহাগ বলল, ওয়াজ দ্যাট গডেস?
পাল্লা হেসে বলল, হ্যাঁ। তোমার গডেস এখন একজন বিগ উওম্যান। অনেক টাকা। শুনলাম স্কুল খুলছে। আমাকে বলে রেখেছে, পাস করলেই চাকরি। কী মজা হবে বল তো!
নাক কুঁচকে সোহাগ বলল, চাকরিতে আর কীসের মজা?
মজা নয়। আমার তো ভাবতেই থ্রিল হচ্ছে। চাও তো তোমার জন্যও বলে রাখি।
সোহাগ হাসল, চাকরি-টাকরি আমার ভাল লাগে না। রোজ একটা লোক একই কাজ কীভাবে করে ভাবতে আমার অবাক লাগে।
আহা, আমরা তো রোজ ভাত খাই, ঘুমোই, দাঁত মাজি। সেগুলোও তো একই কাজ।
সোহাগ কথাটার জবাব দিল না। হেসে বলল, ফ্রক পরে আজ তোমাকে একদম বাচ্চা মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। ভারী সুইট।
লজ্জা পেয়ে পান্না বলে, ফ্রক পরতেই আমার ভাল লাগে কেন বল তো! আজকাল পরছি কেন জান? শাড়ি পরে ঘুমোলে বড্ড জড়িয়ে যায় পায়ে-টায়ে। আমার শোওয়া তো বিশ্রী। একদিন ভোরবেলা উঠতে গিয়ে পায়ে শাড়ি জড়িয়ে দড়াম করে আছাড় খেয়েছি। সেই থেকে শোওয়ার সময় ফ্রক পরে শুই। আজ বড়মার ঘরদোর সারতে হবে বলে ফ্ৰকই পরেছি। কত সুবিধে বল।
দুখুরি এসে বলল, ও দিদি, ঠাকুরঘর সারবে না! সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে যে!
যাচ্ছি, যাচ্ছি, তুই বড্ড হুড়ো দিস।
ইস তাই বইকী। মা তো কোন ভোরবেলা ঠাকুরকে ভোগ দিয়ে দেয়।
সোহাগ বলল, মে আই হেলপ? কিছু কাজ আমিও করতে পারি।
চলো, তাহলে ফুল তুলে আনি।
দোপাটি আর টগর ছাড়া এখন তেমন ফুল নেই বাগানে। আছে, লঙ্কাজবা, দু-পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে কদিন আগে। ঘাস আর আগাছা উঠেছে তেড়েফুঁড়ে। বড় টগর গাছটা থেকে ডিং মেরে ফুল পাড়ছিল পান্না।
হঠাৎ ফোঁস শব্দটা শুনে কেঁপে উঠল। একটু হলেই সাজিটা পড়ে যেত হাত থেকে। চোখ বিস্ফারিত করে নীচে তাকাতেই স্পষ্ট চোখাচোখি হয়ে গেল সাপটার সঙ্গে। একটা চিৎকার দিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ভয়ে কাঠ। সাপের চোখ চোখের পলকে সম্মোহিত করে ফেলল তাকে। সে চোখ সরাতে পারছে না, নড়তে পারছে না, বাকরুদ্ধ, চোখে পলক নেই।
একটু পিছন থেকে এগিয়ে এল সোহাগ।
এই, চেঁচালে কেন? কী হয়েছে? এনিথিং রং?
সাপটা ফণা তুলে আছে স্থির হয়ে। কুটিল চোখে পলকহীন এক দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে বিবশ করে ফেলছে পান্নাকে।
সোহাগ তার হাত ধরে হ্যাঁচকা একটা টানে সরিয়ে নিল। তারপর বলল, ভয় পাচ্ছ কেন? ইট ইজ জাস্ট এ স্নেক।
অজ্ঞানই হয়ে যেত পান্না, সোহাগের হ্যাঁচকা টানে চৈতন্য হল তার।
সে চেঁচাল, পালাও, পালাও।
তাকে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে সোহাগ বলল, টেক ইট ইজি। দেখ, সাপটা চলে যাচ্ছে। দেখ, হাউ ম্যাগনিফিসেন্ট ইট ইজ। সাপের মতো গ্রেসফুল কিছু হয়? ভয়ের কী?
অবাক হয়ে পান্না বলল, তুমি সাপকে ভয় পাও না, না?
আমি কোনও কিছুকেই ভয় পাই না। নট ইভন লোনলিনেস।
.
বেলা বারোটার মধ্যেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেল বলাকা। সিরিঞ্জ ভরে কত রক্ত শরীর থেকে টেনে নিল ওরা। তারপর এক্স-রে, ইসিজি, ইকো কার্ডিওগ্রাম।
বিজু, এবার রেহাই দে বাবা। বাড়ি চল তো, একটু শুয়ে থাকি।
হ্যাঁ বড়মা, সব হয়ে গেছে। এবার যাব।
তুই তো সকাল থেকে দাঁতে কুটোটিও কাটিসনি। মুখখানা শুকিয়ে গেছে।
যা খেল্ দেখাচ্ছ, খিদে উবে গেছে। শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
লাগবে না, কত রক্ত নিয়ে নিল বল তো।
শ্বাসকষ্টটা?
তেমন টের পাচ্ছি না এখন। তবে কোমর টনটন করছে, চোখ মেলে চেয়ে থাকতে পারছি না।
ওটা কাল রাতের সেডেটিভের এফেক্ট। তার ওপর কিছু খাওনি।
রামহরি বিষয়কর্মে কোথাও গিয়েছিল। ফিরে এসে বলল, জল-টল কিছু খাবে বউদি? এখানে একটা দোকানে ভাল রসগোল্লা হয়।
না ভাই। একেবারে বাড়ি গিয়েই যা হয় খাব, স্নানও করিনি তো।
তেষ্টা পেয়ে থাকলে বোতলের জল কিনে আনি।
আমার খিদেতেষ্টা যে কত কমে গেছে আজকাল, তোমরা জান না।
জানব না কেন, খুব জানি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়েছ বলেই তো শরীরের এই হাল। আজকাল সত্তর বাহাত্তর বছরের মহিলারা লিপস্টিক মেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখ গে যাও। তোমার সবতাতেই বাড়াবাড়ি।
বলাকা ক্ষীণ একটু হাসল।
বাড়িতে ফিরেই অবশ্য মনটা ভাল হয়ে গেল। ছেলেরা, বউরা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসে গেছে। বাড়ি গমগম করছে লোকে। বাড়িতে পা দিতেই সবাই যেন আগলে নিল তাকে।
এই তো তার ওষুধ, এই তো চিকিৎসা। গুচ্ছের ট্যাবলেট গিলে কি আর বেঁচে থাকা যায়! বাঁচতে তো মানুষজনও চাই। এই সত্যি কথাটা বলাকা কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারে না। আর পারে না বলেই ভিতরে ভিতরে তার ভূমিক্ষয় হতে থাকে। আজ বুকটা বড় ঠান্ডা লাগছে।
স্নান খাওয়ার পর আজ আর শোবে না বলে ঠিক করেছিল বলাকা, কিন্তু একটু গড়িয়ে নিতে গিয়ে কখন অসতর্কভাবে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধে। ডাক্তার বসে নাড়ি দেখছে। ঘরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সবাই।
কী হয়েছে তার? কী হয়েছে? উঠে বসতে যেতেই মাথাটা কেমন করল।
ডাক্তার অনল বাগচী বলল, না না, উঠবেন না, চুপ করে শুয়ে থাকুন।
আমার কী হয়েছে ডাক্তার?
অনল বাগচী বলল, তেমন কিছুই তো নয়। একটু রেস্ট নিন।
রেস্ট! আর কত রেস্ট নেব বাবা!
ডাক্তার জবাব না দিয়ে প্রেশারের যন্ত্র বের করল।
একটু রাতের দিকে এল মহিম রায়। চোখে জল, গলা আবেগে কাঁপছে, চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন নাকি বউঠান?