আরে রাখো তো ইয়ার এন্ডিং। ওসব করার জন্য তোমাদের অনেক কর্মচারী আছে। শোনো, বড়মার আজ একটু ব্রিদিং ট্রাবল হচ্ছে।
সর্বনাশ! এতক্ষণ বলিসনি?
আরে অ্যালার্মিং কিছু নয়। ডাক্তার এসে দেখে-টেখে গেছে।
আমি তো সন্ধেবেলাতেই মার সঙ্গে কথা বললাম। তখন তো
তখন ছিল না। রাত আটটা নাগাদ ব্যাপারটা হয়। নাথিং সিরিয়াস।
সিরিয়াস না হলে আমাকে তুই যেতে বলতিস কি?
বড়মা নিজেই একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। তোমাদের দেখতে চাইছে।
দাঁড়া আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলব।
আরে দাঁড়াও, শি ইজ আন্ডার সেডেটিভ। আমি তো বড়মার কাছেই আছি। শি ইজ পিসফুলি অ্যাস্লিপ, পারলে চলে এসো।
হ্যাঁ রে, সত্যি করে বল তো সিরিয়াস নয়?
আরে না।
দাদাদের খবর নিয়েছিস?
হ্যাঁ, ফোন করেছিলাম। দে উইল বি হিয়ার বাই টুমরো।
আমার বুকটা কাঁপছে রে। ডাক্তার কী বলল?
ডাক্তার বলেছে, ব্রংকিয়াল ব্লক থেকেও হতে পারে। কাল আমি বড়মাকে ই সি জি করাতে নিয়ে যাব বর্ধমানে। সকালবেলায়।
তুই আছিস, এটাই যা ভরসা।
আমি আছি পারুলদি। চিন্তা কোরো না। বড়মা উইল বি অলরাইট।
ফোনটা যখন রাখতে গেল পারুল তখন তার হাত শিথিল। চোখে জল। মা বাঁচবে তো!
.
দুপুরের খরসান আলোয় সে স্রোতের মতো বয়ে এল এতদূর। সে কি একটু পরিশ্রান্ত? দীঘল শরীর কিছু শ্লথ। সামনে কিছু জটিলতা। ডালপালা আগাছার অবরোধ। সে ধীর গতিতে পেরোল। তারপরই একটা বাধা। বিপদ কি?
সামনেই সাদা, মসৃণ একজোড়া পা। ভারী সুন্দর পা। কোনও সুন্দরীর পা। কিন্তু তার কোনও সৌন্দর্যের বোধ নেই। নারীর মর্মও সে বোঝে না। সে শুধু বোঝে বিপদ, বোঝে বাধা।
সন্দিহান, কুটিল চক্ষুর দৃষ্টিতে সে লক্ষ করল সাদা পা দুখানাকে। শত্রুপক্ষ? খাদ্য? প্রতিরোধ?
একটু অপেক্ষা করল সে। শরীরে তার ভয়ের সংকেত। সে ভয় পায়।
পা দুটো নড়ে। একটু এগোয়, ফের পিছোয়। বিরক্তিকর। সে একটা শ্বাস ছাড়ল। তারপর ধীরে উত্তোলিত করতে লাগল তার ফণা।
.
৭৫.
মনোরম বন্ধনগুলো এইসব সময়ে টের পাওয়া যায়। যেন লতায় পাতায়, মায়ায়, মোহে বেঁধে রেখেছে হাত-পা, এমনকী মগজ আর মনও। কখন বাঁধা পড়ে যায় তা মানুষ টেরও পায় না। এইসব সংকটের ডাক এলে টের পাওয়া যায়। বোঝা যায় একটা সিস্টেমের কত আঁকুশি, কত ফের-ফেরতা। মায়ের অসুখের খবর পেয়ে সকালেই রওনা হবে বলে তৈরি হতে গিয়ে পারুল এইসব বন্ধনকে টের পেল খুব। মাত্র দু-চার দিনের জন্য যাওয়া, তাতেও কত বাধা, কত অসুবিধে। বড় ছেলেমেয়ে দুটোর স্কুল খোলা বলে যাবে না, তার বর নতুন প্রোজেক্ট নিয়ে ছোটাছুটি করছে দিনরাত, তার নিজেরও কি শ্বাস নেওয়ার সময় আছে? তাদের ব্যবসা বাড়ছে, কারখানা বড় হচ্ছে, নতুন কারখানা তৈরি হচ্ছে, কোটি কোটি টাকার লগ্নি। কত দায়ভার তার মাথার ওপরে। তার অনুপস্থিতি ঘরগেরস্থালিতেও কত শূন্যতার সৃষ্টি করতে পারে। এইসব বন্ধন সারা রাত তার হাত-পা শিথিল করেছে, মন হয়েছে বিকল। এখন হুট বলতেই ছুটকারা পাওয়া বড় কঠিন। একটা ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল করছে তারা, চলছে একটা কম্পিউটার আর স্পোকেন ইংলিশ ইন্সটিটিউট। সবই পারুলের দায়িত্বে। আর দায়িত্বটা বিশাল। সে তার বরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই কাজ করে। কত বেকার ছেলেমেয়ের সামনে সম্ভাবনার পথ খুলে দিচ্ছে তারা।
খুব সকাল থেকেই বারবার ফোন করেছে মাকে। মা ধরেনি, ধরেছে বিজু বা পান্না।
বিজু বলল, আরে, টেনশনের কিছু নেই। তুমি ধীরেসুস্থে এসো।
মায়ের সঙ্গে কথা বলা যাবে না?
কেন যাবে না? কিন্তু এখনও ঘুমোচ্ছে যে।
মা তো এত বেলা অবধি ঘুমোয় না।
এটা তো নরম্যাল ঘুম নয় পারুলদি। শি ইজ আন্ডার সেডেটিভ।
ইস, আমার যে বুকের মধ্যে কেমন হচ্ছে।
ডাক্তার তো অ্যালার্মিং কিছু বলেনি, ভাবছ কেন?
ডাক্তারটা কেমন?
অনল বাগচীর খুব নাম। এদিকে সবাই তো প্রশংসাই করে। বিদেশি ডিগ্রি আছে।
পারুল বাচ্চাটাকে নিয়ে রওনা হল দশটা নাগাদ। তাদের সদ্য কেনা এ-সি গাড়িতে, সঙ্গে আয়া, লাঞ্চের বাস্কেট, জল।
তার মোবাইলে সবসময়ে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। তবু ঘণ্টা খানেক বাদে পান্নাকে পাওয়া গেল ফোনে।
কী খবর রে, মা কেমন?
তুমি আসছ তো! ওঃ কী ভালই যে হবে।
দুর মুখপুড়ি, মায়ের কথা বল।
বড়মাকে নিয়ে বিজুদা তো বর্ধমানে গেছে। ই সি জি হবে, আরও কী কী সব টেস্ট যেন।
মা নরমালি যেতে পারল?
হ্যাঁ তো।
ব্রিদিং ট্রাবলটা?
একটু আছে। খুব সামান্য। সবাইকে দেখতে চাইছে। বড়মার ধারণা হয়েছে, আর বাঁচবে না। শুনে আমরা খুব হাসিঠাট্টা করেছি।
আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে।
অত ভেব না। আমরা তো সবাই কাল রাতে বড়মার কাছে ছিলাম।
কে কে?
বাবা, আমি, ছোটমা, বিজুদা। একজন নার্সও ছিল। তুমি একদম ভেব না। বড়মা ঠিক আছে।
মায়ের যদি সিরিয়াস কিছু না-ই হবে তবে তোরা সবাই মিলে মায়ের কাছে রাতে ছিলি কেন?
আমরা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বড়মার তো কখনও তেমন অসুখ-বিসুখ করে না। তাই স্বাসকষ্ট হচ্ছে শুনে সবাই চলে এলাম। আজ সকালে সোহাগও চলে এসেছে খবর শুনে। তুমি এখন কোথায় পারুলদি? গলাটা অস্পষ্ট শোনাচ্ছে কেন?
কোথায় তা কি আমিই জানি? একটা পেট্রল পাম্পে থেমেছি। গাড়িতে তেল নেওয়া হচ্ছে। যেতে যেতে বিকেল হয়ে যাবে।