ঘাসজমিতে উঁচু হয়ে থাকা হাতখানা বাতাসে খানিক দোল খাচ্ছিল। তার সাদাটে বুকে রোদ। চারদিকটাকে পেরিস্কোপের ভঙ্গিতে বুঝবার চেষ্টা করছিল সে। তারপর ধীরে ধীরে ডুবে গেল ঘাসের গভীরে।
আমার অনেকদিন ধরে একটা সাপ পুষবার শখ।
আচ্ছা মেয়ে রে বাবা! তুই বোধহয় সব পারিস। আমার বুকটা এখনও ধকধক করছে।
হি হি করে হাসল সোহাগ, কেন ভয় পাও পিসি? আমার তো একটুও ভয় করে না। আমি একদিন সাপটাকে ফলো করব। দেখব ও কোথায় কোথায় যায়, কী কী করে, ওর লাইফ স্টাইলটা কীরকম। হাত নেই। পা নেই। শুধু একটানা একটা শরীর, আশ্চর্য না?
এবার সন্ধ্যাও হেসে ফেলে, তার পর গম্ভীর হয়ে বলে, ওসব যদি করিস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি, এই বলে রাখলাম।
.
কেমন আছো পারুলদি?
একটু আগেই রাত এগারোটা বেজেছে, পারুল জানে। তবু একবার দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকাল। এগারোটা কুড়ি। বলল, অ্যাই হনুমান, রাত সাড়ে এগারোটায় ফোন করে কুশল প্রশ্ন করা হচ্ছে? ব্যাপারটা কী তোর?
আহা, রাত সাড়ে এগারোটায় একটা লোক কেমন আছে তা জানার কৌতূহল কি হতে পারে না? ধরো সকালে হয়তো লোকটা ভাল আছে, বিকেলে খারাপ, রাত এগারোটায় হয়তো খুব ভাল। সেইজন্যই কুশল প্রশ্নও বিভিন্ন সময়ে, এমনকী আনগডলি আওয়ারেই করা উচিত।
থাপ্পড় খাবি।
শুয়ে পড়েছিলে নাকি?
না রে। ইয়ার এন্ডিং আসছে, হিসেবপত্তর নিয়ে বসেছি।
তোমার ছোটো ছেলেটা? হাউ ইজ হি?
ছেলের নামে একটু উথলে ওঠে পারুল। মাত্র তিন মাস বয়েস। তবু তার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা দেখতে পায় পারুল। মায়েরা দেখে।
আর বলিস না ভাই, যা দুষ্টু হয়েছে। ওকে নিয়েই তো সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়।
কেন, তোমাদের আয়া-টায়া নেই?
তা আছে। দুজন। তবু এটাকে আমি নিজের মতো করে মানুষ করতে চাই বলে আয়াদের কাছে। বেশি দিই না। হ্যাঁ রে বিজু, এত রাতে ফোন করলি যে হঠাৎ!
আরে আজকাল কেবল টিভি-র গুণে কোনও বাড়িতেই কেউ রাত বারোটা-একটার আগে শুতে যায় না। তাই ভাবলাম, তোমাকে একটু ফোন করে খবর নিই।
আসলে বেশি রাতে ফোন এলে বুকটা ধক করে ওঠে। কার কী হল সেই চিন্তা হয়।
আরে না না। ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
তোর খবর কী?
নাথিং নিউ। যথাপূর্বং।
বাজে বকিস না। সব জানি।
কী জানো?
পান্নার সঙ্গে ফোনে আমার কথা হয়।
পান্না! ও আবার কী লাগিয়েছে তোমার কাছে?
যা সত্যি তাই বলেছে।
দুর দুর। যা শুনেছ সব বাজে কথা।
কী শুনেছি তা জানলি কী করে? এখনও তো বলিনি কিছু।
আসলে ওই সোহাগকে নিয়ে তো!
হ্যাঁ তো!
গাঁয়ের লোকেরা কূপমণ্ডুক হয়, জানো তো! মুখরোচক কিছু পেলেই হল।
তাহলে কি ঘটনাটা কি সত্যি নয়?
আরে না। আমার কম্পিউটারে ই-মেল চেক-টেক করে। বেশি কথাও হয় না আমাদের। বিশ্বাস করো।
করলাম। সোহাগ অন্য রকমের মেয়ে। অন্য সব মেয়ে যা করে ও তা কিছুতেই করবে না। সত্যি কথা বল তো, ওকে তোর ভাল লাগে?
এমনিতে ঠিকই আছে।
পছন্দ?
আহা, পছন্দের কথা উঠছে কেন?
বল না, আমি অনেকদিন আগেই মনে মনে তোর জন্যই ওকে বাছাই করে রেখেছিলাম।
তোমাদের কি সব সম্পর্কের একটা হেস্তনেস্ত না করে শান্তি নেই?
হেস্তনেস্ত আবার কী? মেয়ে পুরুষের দুজনের দুজনকে পছন্দ হলে বিয়ের কথা তো উঠবেই।
পারুলদি, তুমি কিন্তু কিছুদিন আগেও এত সেকেলে ছিলে না।
তোর আর বেশি একেলে হওয়ার দরকার নেই। তৈরি হ।
পাগল নাকি! এখনও আমার প্র্যাকটিস জমেনি।
বাজে কথা বলিস না। সব খবর জানি।
কী জানো?
বাবার সব মক্কেল এখন তোর হাতে। বাবার অর্ধেক করা মামলাগুলো সব তুই হাতে নিয়েছিস এবং এখন তোর রোরিং প্র্যাকটিস–ঠিক বলেছি?
যা শুনেছ ততটা নয়। যে কোনও গল্পের চারাগাছই বর্ধমান থেকে জামশেদপুর যেতে যেতে মহীরুহ হয়ে যায়।
গাড়িও তো কিনেছিস শুনলাম। সেটা কি আকাশ থেকে পড়ল?
আরে সেকেন্ডহ্যান্ড মারুতি এইট হান্ড্রেড, ও তো আজকাল হকারদেরও থাকে।
বাজে বকিস না, গাড়ির বাজার আমি ভালই জানি। সেকেন্ড হ্যান্ড কিনলি কেন? পান্না যে বলল, নতুন গাড়ি।
এক রকম নতুনই। আমার এক মাড়োয়ারি ক্লায়েন্ট কিনেছিল। হাজার কিলোমিটারও চলেনি।
হাজার কিলোমিটার! তাহলে তো একদম নতুন।
ওই এক রকম।
আর বিনয় করতে হবে না। গাড়িতে সোহাগকে চড়িয়েছিস?
সাহস পাইনি।
তার মানে?
ও ওসব গাড়িবাজি পছন্দ করে না।
তাহলে কী পছন্দ করে?
চুপচাপ বসে থাকা।
ওমা! তোদের মধ্যে ভালবাসার কথা হয় না?
পাগল নাকি?
তোরা কী রে?
এসব পোস্ট মডার্ন পারুলদি, তোমরা বুঝবে না। বড্ড সেকেলে আছ এখনও।
একটু পাগলি আছে ঠিকই, কিন্তু শি ইজ ভেরি গুড অ্যাট হার্ট, আমাকে কেন যে গডেস ভাবত কে জানে!
তোমাকে অনেকেই গডেস ভাবত পারুলদি।
মারব গাঁট্টা। কে আমাকে গডেস ভাবত রে?
এ-গাঁয়ের তৎকালীন ব্যর্থ যুবকেরা।
তোর মুন্ডু। শোন, তোদের ওই পোস্ট মডার্ন সম্পর্কটা যেন কেটে না যায়। আজকাল ছেলেতে-মেয়েতে ভাবসাব হতে না হতে বড্ড ছাড়কাট হয়ে যায়। তুই তো আবার কাঠখোট্টা গোঁয়ারগোবিন্দ গোছের, তার ওপর পিউরিটান। তোর যে কী হবে কে জানে বাবা।
আমার কিছু হওয়ার নয়।
সেই জন্যই তো ভয়। তুই যেমন বেরসিক, তেমনি জুটেছে তোর সোহাগ পাগলি।
ইয়ে পারুলদি, কাল পরশু একবার চলে এসো না।
দুর পাগল! এখন কি আর যাওয়ার উপায় আছে! বললাম না ইয়ার এন্ডিং।