এই একটা জায়গায় তোমার ভীষণ উইকনেস, তাই না পিসি? নইলে এমনিতে তুমি বেশ হার্ডেনড মেয়ে।
তোরা হলে সে চাইতেই সাহস পেত না। সে লোক চেনে। সে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না বটে, কিন্তু আমি তো মন থেকে উপড়ে ফেলতে পারিনি সম্পর্কটা। তাই দুর্বল হয়ে পড়ি।
তোমরা একটু কেমন যেন আছ। তাই না? তুমি, বলাকা।
এই ধিঙ্গি মেয়ে, বলাকা কী রে? আমরাই জেঠিমা ডাকি।
তা হোগ গে, আমার তো খুব বন্ধুর মতো মনে হয়।
দেব মাথায় গাঁট্টা, তা জেঠিমার আবার কী হল?
তোমার মতোই। একজন পুরুষকে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। এটা কী করে হয় তাই ভাবছি। তোমাদের অবস্থা তো দাসীবাদির চেয়েও খারাপ।
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বলল, তা নয় রে।
তাহলে?
সমাজের নিয়ম কি সব সময়ে সকলের ক্ষেত্রে খাটে? মানুষের মনের ভিতরটায় কত কী আছে, বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না।
তা বলে তুমি লোকটাকে টাকা দেবে?
দেবো বলিনি। ভাবছি। আমার তো অনেক টাকা জমে আছে, আমি মরলে সে টাকার কী গতি হবে কে জানে। তা সেই লোকটার যদি উপকার হয় সে কথাই ভাবছি। টাকা দিলে লোকটার হয়তো একটু আক্কেলও হবে। আয়নায় নিজের মুখ দেখতে লজ্জাও করবে। তাই না, বল!
সেসব আমি জানি না। শুধু জানি, তোমার কিচ্ছু হবে না। তুমি এক্কেবারে যা-তা।
সন্ধ্যা হেসে ফেলে। তারপর হঠাৎ চোখের জল সামলাতে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে চোখে। একটু চুপ করে থাকে। তারপর ধরা-ধরা গলায় বলে, তবু যা হোক আমার একটা দাম হয়েছে তো তার কাছে, এতদিন বাদে। একটু গুরুত্ব তো দিচ্ছে, হাত পাতছে।
তোমার যা খুশি কর গে। আমি তোমাকে নিয়ে আর পারি না।
সত্যিই বলেছিস, আমি একেবারে যাচ্ছেতাই। বড্ড সেন্টিমেন্টাল। কিন্তু কী জানিস, কয়েকদিন আগে বড়দার ঘরে টি ভি-তে একটা সিনেমা দেখছিলাম। ইংরেজি ছবি। তাতে একটা মেমসাহেব একটা সাহেবের জন্য যা ল্যালামি করছিল দেখলে তোর রাগ হত। ছেলেটা মেয়েটাকে একদম পাত্তা দিচ্ছিল না, একবার তো ধাক্কা মেরে ফেলেই দিল। গালাগালও করছিল যেন। তবু মেয়েটা এমন হ্যাংলামি করছিল যে বলার নয়। ইংরিজি তো ভাল বুঝি না। ছবিটা দেখে ভাবলাম, সাহেবদের দেশেও তো এরকম হয়। ওরা অবশ্য স্বামী-স্ত্রী ছিল না, প্রেমিক-প্রেমিকাই হবে।
সেই ছবিটাই বুঝি তোমার ইনস্পিরেশন?
না রে। ছবিটা দেখে মনে হল, এরকম হয়, হতে পারে। ও-দেশে যেমন হয়, এ-দেশেও তেমন হয়।
সোহাগ হেসে ফেলল। বলল, এই জন্যই তোমাকে এত সুইট লাগে আমার।
সন্ধ্যা লাজুক হেসে বলে, বোকা বলে তো!
একজ্যাক্টলি। তুমি একদম বুদ্ধ আর বোকা। তাই এত সুইট। বুঝলে?
ভাগ্যিস বুদ্ধিমতী হইনি, তাহলে তো আমার সঙ্গে তোর এত ভাব হত না। হত, বল?
বোধহয় না।
হ্যাঁ রে, আমার পুষ্যি মেয়ে হবি?
ও আবার কী কথা পিসি? আমি তো তোমার মেয়েই।
মা বলে তো ডাকিস না!
তা ডাকতে পারি। কিন্তু তুমি যে মায়ের মতো বড় নও।
আমার বয়সই বুঝি বসে আছে!
তাহলেও তুমি আমার মা হওয়ার পক্ষে একটু বেশি ইয়ং।
সন্ধ্যা লাজুক হেসে বলে, তা অবিশ্যি ঠিক। আমি মা আর বাবার বুড়ো বয়সের সন্তান। বেশি বয়সে সন্তান হওয়াতে নাকি মা-বাবার নিন্দে হয়েছিল। থাক বাবা, পিসিই ডাকি। মা ডাকলে আবার পাঁচটা কথা উঠবে। বউদিও পছন্দ করবে না। আসল কথা কী জানিস? একটা ভালবাসার লোক থাকলে কাজকর্ম করে একটা আনন্দ হয়। আমি ভেবে রেখেছি আমার সব টাকা-পয়সা, ব্যবসা-ট্যাবসা সব তোকেই দিয়ে যাব।
সে তো বুঝলাম। কিন্তু তুমি যাবেটা কোথায়?
যখন মরব তখনকার কথা বলছি।
হ্যাঁ পিসি, তোমার বুঝি ইচ্ছামৃত্যু?
কেন রে, একদিন কি মরব না?
ইউ আর ইন মিড থার্টিজ। মরার বয়স হতে যে ঢের দেরি। ততদিনে আমি কোথা থেকে কোথায় চলে যাব তার কি ঠিক আছে? হিসেব করলে তোমার যখন মরার বয়স হবে তখন আমিও বুড়ি হয়ে যাব।
দুজনেই খুব হাসল।
কথা হচ্ছিল নিমের ঝিরঝিরে ছায়ায় দুটো মোড়া পেতে বসে। পাশেই ধানের মরাই। সামনে অনেকটা ঘাসজমি। একটা সুঁই কুমড়োর গাছ লতিয়ে গেছে অনেক দূর অবধি। কুমড়ো ফলেছে অনেক। সবজে-সাদা কচি কুমড়ো বয়ার মতো ভেসে আছে ঘাসের ওপর। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে সকালবেলার রোদে ওই ঘাসজমিটা।
মুগ্ধ হয়ে চেয়ে ছিল সোহাগ। অবাক হয়ে দেখল ঘাসজমিটার মাঝামাঝি জায়গায় হঠাৎ একটা হাত উঠে আসছে শূন্যে। যেন ডুবন্ত কোনও মানুষ জলের ওপর অসহায় তার হাতখানা তুলে দিয়েছে। অবাক চোখের বিভ্রম খসে পড়তেই ঝট করে উঠে দাঁড়াল সোহাগ।
সন্ধ্যা বলল, কী রে? কী হল?
দ্যাট স্নেক! আই লাভ দ্যাট স্নেক।
সন্ধ্যাও দেখতে পেল। প্রকাণ্ড পাকা বয়সের গোখরোটা ফণা তুলে আছে।
কোথায় যাচ্ছিস! বলে আর্তনাদ করে ওঠে সন্ধ্যা।
দাঁড়াও। আই মাস্ট হ্যাভ এ ক্লোজ লুক। বলেই ঘাসজমির দিকে ছুটে গেল সোহাগ।
করিস কী পাগল! মরবি নাকি? বলে সন্ধ্যা ছুটে গিয়ে একটা হাত ধরে ফেলে টেনে আনে সোহাগকে।
সোহাগ হিহি করে হেসে বলে, তুমিই না বলেছ ওটা বাস্তুসাপ! আমাদের পোষা।
দুর বোকা! বাস্তুসাপ বলেই কি আর বিষ নেই নাকি?
তুমি যে বলেছিলে ওরা কামড়ায় না!
সন্ধ্যা ভয়ার্ত চোখে সোহাগের দিকে চেয়ে বলে, সর্বনাশী মেয়ে বাবা তুই! বাস্তুসাপ বলে কি বুকে টেনে নিতে হবে নাকি? ক্ষেপি কোথাকার!
আমার যে খুব বিশ্বাস হয়েছিল, ওটা আমাদের পোষমানা সাপ।