ভগবানের কথা উঠলে ধীরেন সত্যিকারের কাঁচুমাচু হয়ে পড়ে। ওই একটা ব্যাপারে সে বরাবর কঁকিতে থেকেছে। তার কেবলই মনে হয়, ও নাগালের বাইরের ব্যাপার। ধীরেন ঠিক নাস্তিক নয়, তবে ভাবে, তিনি যদি আছেন তো সবই দেখছেন-টেখছেন, সবই বুঝছেন, আর যা করার করবেনই। ডাকাডাকি করে লাভ নেই। ধীরেনের ডাকে বাড়ির পোষা কুকুরটাও নড়তে চায় না, ভগবান কোন ছাড়।
কফিতে আরও একটা চুমুক দিয়ে ধীরেন বলে, ভগবানকে ডেকে তেমন জুত পাই না দাদা। পাপীতাপী মানুষ তোতা। কত অপকর্ম করে বসে আছি, ভগবান তেমন খেয়াল করেননি হয়তো। ডাকাডাকি করলে হয়তো নড়েচড়ে বসবেন, ভাববেন, দেখি তো ব্যাটার খাতাখানা খুলে পাপপুণ্যির হিসেবটা। তাহলেই তো হয়ে গেল। একেবারে চিৎপাত করে ফেলে দেবেন।
তোকে নিয়ে আর পারা যায় না।
হেঁঃ হেঁঃ করে একটু হাসে ধীরেন কাষ্ঠ। তারপর বলে ধর্মকর্ম করতে বড় দেরিও হয়ে গেছে। এখন ওসব করতে গেলে ভগবান ভাববেন, মশকরা করছি। আরও একটা কথা দাদা।
কী কথা! বলে ফেল।
ভিতু মানুষের কি ধর্মকর্ম হয়? সব ব্যাপারেই যারা জুজুবুড়ি দেখে তাদের ধর্মকর্মেও জুজুবুড়ি ঘাপটি মেরে থাকে। ডাকছে হয়তো কালী বা কেষ্ট ঠাকুরকে, কিন্তু মনের মধ্যে খাপ পেতে আছে জুজুবুড়ির ভয়। তাই পুজো শেষ অবধি ওই জুজুবুড়ির পায়ে গিয়েই পড়ে।
দামড়া কোথাকার। তবে কথাটা খুব খারাপও বলিসনি। আমার এক বিধবা পিসিমাকে দেখেছি ধর্মের নামে এমন শুচিবায়ু করে বেড়াত যে শেষ অবধি মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছিল। তবু বলি ধর্ম না করিস অধর্মও করতে যাস না।
কফির কাপটা জগের জল দিয়ে ধুয়ে সাবধানে রেখে ধীরেন উঠল।
বড্ড রোদ ওঠে আজকাল, ছাতা নিয়ে বেরোসনি?
পুরনো ছাতাটার শিক-টিক ভেঙে রয়েছে দেখলাম। না সারালে চলবে না।
এই রোদ বেশি মাথায় না লাগানোই ভাল। তোর যে বয়স হয়েছে সে খেয়ালটা রাখিস তো!
রেখেই বা হবে কী? বয়সকে তো কেউ খাতির করছে না। রোদে জলে মরব কিনা বলতে পারি না। তবে মনে হয়, মরণ এখনও দূরে আছে।
ভাল, দূরে থাকাই ভাল।
কিন্তু খুব দূরেও ছিল না মরণ। সেটা মহিমদাদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে শর্টকাটে যাবে বলে ঘাসজমিতে কয়েক কদম হাঁটার পরই টের পেল ধীরেন।
দুদিন বৃষ্টি গেছে মাঝখানে। তাইতেই ঘাসগুলো যেন তেজালো হয়েছে একটু। চটিসুদ্ধ ডান পা বাড়িয়ে ফেলতে গিয়েও তার সদ্য কাটানো বাঁ চোখ ঘাসের গভীরে চিত্রল একটি হিলিবিলি চকিতে দেখতে পেয়ে গিয়েছিল।
বাপ রে! বলে ধীরেন পিছোতে গিয়ে বেকায়দায় চিত হয়ে পড়ে গেল পিছনে। সাপটা প্রায় গা ঘেঁষে ফিসফাস করে আপন মনে কথা কইতে কইতে চলে গেল দূরে।
মাজায় বেশ লেগেছে। ধীরেন উঠে বসল। একটু দম নিয়ে হাঁটুতে ভর করে দাঁড়াল। না, তেমন কিছু নয়। অল্পের ওপর দিয়েই চোটটা গেছে। সে ঘাসজমি ছেড়ে রাস্তা ধরল।
বাঁ চোখই বাঁচিয়ে দিল তাকে। বেঁচে গিয়ে বড় আনন্দ হচ্ছে তার। অনেকটা কামভাবের মতোই যেন একটা কিছু, ভারী অদ্ভুত লাগছে বটে। আনন্দটা একটা যেন সুড়সুড়ির মতো। সাপের বিচিত্র শরীরের এই গতি ওর মধ্যে কামের কোনও অনুষঙ্গ আছে নাকি রে বাবা! আশির কাছাকাছি বয়সে এসব আবার কীরকম ভাবসাব?
একবার ভাবল ফিরে গিয়ে কথাটা মহিমদাদাকে জিজ্ঞেস করবে। তারপর ভাবল, কাজ কী, তার কথাকে তো কেউ গুরুত্ব দেয় না। এই আবছা মাথায় সে যা বুঝেছে ওটুকুই তার থাক। বেশি বুঝে হবে কী।
.
তোমার হাতে পোস্টকার্ডটা দেখে আমার ভীষণ অবাক লাগছে।
কেন রে?
সেদিন স্বপ্ন দেখছিলাম তোমার বর তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছে আর তুমি তার কাছে চলে যাচ্ছ সব ছেড়েছুঁড়ে।
ও মা! বলিস কী? সত্যি স্বপ্ন দেখেছিলি?
হ্যাঁ পিসি। আমি তোমার ওপর খুব রাগ করছিলাম।
অবাক কাণ্ড তো!
কেন পিসি?
এ তো সত্যিই তার চিঠি রে! আজকের ডাকেই এল! হা রে, তোর মধ্যে তো ভগবান অনেক ক্ষমতা দিয়েছেন!
দুর! ওসব কিছু নয়। এটা সত্যিই তোমার হাজব্যান্ডের চিঠি?
হ্যাঁ। তবে এটা প্রথম নয়। মাস তিনেক আগে আরও একটা লিখেছিল। তাতে শুধু কুশল প্রশ্ন ছিল। আমি অবশ্য জবাব দিইনি।
এবার চিঠিতে কি তোমাকে যেতে লিখেছে?
করুণ একটু হেসে সন্ধ্যা বলল, না রে, সে আর আমাকে চায় না। তবে আমার টাকা চায়। পড়ে দেখ না। প্রেমপত্র তো নয়।
ও বাবা। আমি ছাপা বাংলা পড়তে পারি, কিন্তু হাতের লেখা বাংলা পড়তে পারি না। আর এই ভদ্রলোকের হ্যান্ডরাইটিং ভীষণ জড়ানো। তুমিই পড়ো না।
ও আর পড়ে কী হবে। দুর্গাপুরের কাছে কোথায় যেন বাড়ি করছে। টাকার জন্য কাজ আটকে গেছে। খুব করুণ করে কিছু ধার চেয়ে পাঠিয়েছে।
হি ইজ শেমলেস, তাই না?
আমি ভাবি, আমার আর কোনও খবর তার কাছে না পৌঁছলেও আমার টাকার খবর কিন্তু ঠিক পৌঁছে গেছে। টাকার কত ক্ষমতা দেখেছিস?
খবরটা কে দিল পিসি?
কত লোক আছে। মেয়েমানুষ ব্যবসা করে পয়সা করছে দেখে কত লোকের আঁতে লাগে, চোখ কটকট করে। তাদেরই কেউ জানিয়ে দিয়েছে।
দেবে নাকি টাকা?
এখনও ভাবিনি কিছু। আমার তো আর তার সংসার করা হল না, টাকাও জমে যাচ্ছে। কী করব বল তো! দেওয়া উচিত হবে কিনা সেইটেই ভেবে পাচ্ছি না।
ধার নিয়ে যদি শোধ না দেয়?
সেটা যে দেবে না তা খুব জানি। ধার বলে দেবও না। আমি শুধু উচিত অনুচিতের কথা ভাবছি।