কিন্তু কথা হল, ধীরেনেরও একটা আলাদা ছোট দুনিয়া আছে, যেমন সব মানুষেরই থাকে। সেই দুনিয়ায় ধীরেনের বোকা-বুদ্ধিতে নানা অদ্ভুত জিনিষ ধরা দেয়। এই সেদিন রাখাল রায়ের বাড়িতে দ্বাদশ ব্রাহ্মণ খাওয়াল। মায়ের বাৎসরিক, ধীরেন বামুন নয়, তবু পুরনো একটু আত্মীয়তা ছিল বলে তাকেও ডেকেছিল খেতে। ধীরেন এখন তু বললেই যায়। তা খাসির মাংস হয়েছিল সেদিন! হাড় চিবোতে গিয়ে ধীরেন টের পেল যৌবনকালে মাংস খাওয়ার সময়ে দাঁতের একটা আলাদা আনন্দ হত। মোটা মোটা হাড়ের মধ্যে ননী লুকিয়ে থাকে। চুষলে বেরোতে চায় না। পিছন দিকটা ভেঙে ভেন্টিলেশন না করে নিলে ওই ব্যাটা ননী বেরোবেও না। তা তখন সঁতের জোর ছিল বটে, কড়াক করে মোটা হাড়ের গোড়া ভেঙে হাড়ের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ননী বের করত। রাখালের বাড়িতে সেদিন খেতে বসে দেখল দাঁতের আর আনন্দ হচ্ছে না। হাড় ভাঙতে গিয়ে দাঁতই ভেঙে যাওয়ার দশা, ননীচোরা হাড় পাতে ফেলেই উঠতে হল।
বুড়ো হলে কোনও কোনও প্রত্যঙ্গে আনন্দ কমে যায় বটে, তবে কিছু থাকেও। এই যে তার চোখ দুখানা, দুটোতেই ছানি পড়েছিল। যত মলিন হল দৃষ্টি ততই যেন চোখ দুখানা মন খারাপ করে থাকত। এখন বাঁ চোখের ছানি কাটার পর একটা চোখে আনন্দ নেচে বেড়াচ্ছে। দেখে দেখে যেন আর ফুরোতে চায় না দেখা। কত কী দেখতে পায় ধীরেন এখন, মনে হয় যেন যৌবনকালেও এত ভাল দেখতে পেত না। সবই ভারী নতুন নতুন লাগে আজকাল।
নিজের বউয়ের মুখখানা সেদিন ভাল করে দেখছিল। সোজাসুজি নয়, সোজাসুজি তাকাবে অত সাহস আর নেই ধীরেন কাষ্ঠের। বউ পাঁজি না কী একটা উলোঝুলো চটি বই খুলে দেখছিল দাওয়ায় বসে। পাশ থেকে বাঁ চোখ দিয়ে খুব মন দিয়ে দেখছিল ধীরেন। কিছু ইতরবিশেষ মনে হল না। যৌবনের মুখটা তো নেই, সেই জায়গায় কোন কুমোর এসে যেন আর একখানা মুখ বসিয়ে দিয়ে গেছে। যৌবনেও খ্যাকানো স্বভাব ছিল, তবে একটা চটক ছিল তখন। দেখতে তেমন খারাপ ছিল না, স্বভাবটা আরও তিরিক্ষে হয়েছে, আর মুখটা যেন অন্য মানুষের মুখ। তবু এই বউকে নিয়েই তো তার উত্তাল যৌবন ভারী উদ্দীপ্ত হত।
আজও কি হয়? নির্লজ্জ ধীরেন কাষ্ঠ সেই রাতে, এই বৃদ্ধ বয়সে তার বউয়ের কাছে শরীর চেয়েছিল। ওই বয়সে ভাটিয়ে-যাওয়া শরীর। তার বউ খুব অবাক হয়ে তার দিকে হ্যারিকেনের নিবু নিবু আলোয় চেয়ে থেকে বলেছিল, গলায় দড়ি দাও গো বেহায়া বেল্লিক পুরুষ।
না, অপমান আর গায়ে লেগে থাকে না আজকাল। তবে অপমানে পুরুষের কামজ্বর ছেড়ে যায়। সুরুত করে পারদ নেমে যায় নীচে। তবে ধীরেনের আত্মগ্লানি নেই। চেয়েছিল, দিল না, ব্যস।
তবে এই যে অনেকদিন পর কাম ভাবটা, এটা বোধহয় ছানি কাটানো চোখটারই গুণ। নইলে হয় কী করে?
ধীরেন ভেবেছিল, বাকি জীবনটা এক চোখেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। ডান চোখ কাটানোর হাঙ্গামায় আর যাবে না। আজকাল ভাবে, তা কেন, এবার ডান চোখটাও কাটিয়ে নেওয়া যাক। শুধু দেখাই তো নয়। চোখের ভিতর দিয়ে নানা দৃশ্য এসে তার ভিতরটাকেও বোধহয় ঝাড়পোঁছ করে দিচ্ছে। পুরনো ঘরে নতুন রং লাগাচ্ছে। চোখের আনন্দে তার ভাটিয়ে-যাওয়া বয়সও ফিরে আসছে বুঝি।
দুজনে কফি খেতে খেতে মহিম গম্ভীর মুখ করে সব শুনল। তারপর একটু হেসে বলল, তোর মাথাটাই গেছে। পাগল কোথাকার! অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আবার আলাদা করে আনন্দ হয় নাকি? যত সব বাহাত্তুরে কথা।
ধীরেন কাষ্ঠ তর্ক করে না। তার পেটে বিদ্যে আর মাথায় বুদ্ধি কোনওটাই নেই। বড় মানুষদের সঙ্গে তাই সে কখনও কথার লড়াইতে নামে না। সে জানেই বা কতটুকু, বোঝেই বা কি। কিন্তু প্রকাশ্যে মেনে নিলেও মনে মনে সে যা বুঝেছে তাই বুঝেছে। যদি তা ভুলও হয় তাতেই বা কী? কত ভুল আঁকড়ে থেকে মানুষ বেমালুম জীবন কাটিয়ে দেয়। সব সত্য জানতেই হবে এমন কী মাথার দিব্যি দেওয়া আছে? দুনিয়াটা যে যার নিজের মতো করেই বোঝে। দুনিয়া তো আর একটা নয়। যত মানুষ তত দুনিয়া। ওই যে সব কুকুর বেড়াল পশুপাখি ওদের দুনিয়াও আলাদা রকমের। ধীরেন এরকমই বোঝে। আর বুঝটা যদি একদিন ভেঙে যায় তবে তার খুব কষ্ট হবে।
মহিম দুলে দুলে হাসছিল, বউমার ওপর চড়াও হয়েছিলি এই বয়সে, তোর আক্কেলটা কী রে?
কাঁচুমাচু হতে গিয়েও হতে পারল না ধীরেন। হেসে ফেলল, কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল, একটা তাড়নার মতো হল, ভাবলাম দোষের তো কিছু নয়।
তোর বয়স আশি ছাড়িয়েছে না?
তা তো হবেই।
ওসব করতে গেলে হার্ট অ্যাটাক না হয়ে যায়। পাগল কি আর গাছে ফলে! আহাম্মক কোথাকার।
ধীরেন আহাম্মকের মতোই হাসছিল। তার পেটে কোনও কথা থাকতে চায় না। কাউকে না কাউকে বলে ফেলে, আগে গৌরহরিদাদাকে সব বলত। আজকাল মহিমদাদাকে বলে। বলে ফেলার মধ্যে একটা খালাস আছে। বললেই মনের ভারটা কমে যায়। অনুতাপ-টাপও থাকে না তেমন।
এই চোখটা কাটিয়ে ইস্তক আমার কীসব যেন হচ্ছে। ঠিক আগের মতো আর নেই আমি। মাঝে মাঝে ভারী ফুর্তির ভাব আসে। শরীরেও কীসব চাগাড় দিয়ে উঠছে।
দুনিয়ায় কত লোক ছানি কাটাচ্ছে তাদের এরকম ধারা হচ্ছে বলে শুনিনি তো! তোরই সব উদ্ভুটে ব্যাপার হয় কেন?
সেটাই তো ভাবছি।
এই বয়সে অত উচাটন ভাল নয়। সামলে সুমলে থাক। ঠাকুর-দেবতার নাম করলেও তো পারিস।