দুর পাগল। কী যে বলে! শোনো মেয়ে, আমার বিয়ে হয়েছিল মাত্র দশ বছর বয়সে। তখন আমার স্বামীর বয়স পঁচিশ বছর। এরকম বয়সের তফাতে বিয়ের কথা আজকালকার ছেলেমেয়েরা ভাবতেও পারবে না। তখন স্বামী কী জিনিস, তার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয় তাই তো জানতাম না। অন্য পুরুষ হলে কী করত জানি না, কিন্তু আমার স্বামী আমাকে আগলে আগলে রাখতেন, অনেকটা বাবার মতো। অসুখ হলে বাপের বাড়ি না পাঠিয়ে নিজে সেবা করতেন। ভালবাসা তো এমনি এমনি হয় না।
একটা কথা জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবেন?
না রে বাপু!
ডিড হি ট্রাই সেক্স?
পাগল নাকি? সে সেইরকম পুরুষমানুষই ছিল না। শক্তিমান পুরুষের লক্ষণ কী জানো? সংযম। আর মেয়েরা শক্তিমানকেই সর্বস্ব দিতে চায়। এ তোমাদের মাসল ফোলানো শক্তি তো নয়।
ওঃ, ইউ রিয়েলি ওয়ারশিপ হিম।
বলাকা হেসে ফেলে বলল, শুনে শুনে কান পচে গেল। আমি তো জানি না কী এমন হাতিঘোড়া করেছি তার জন্য। আমি তো চেষ্টা করে কিছু করিনি। ভালবাসা হলে সব ভেসে যায়। দেখো না, এখন কেমন শূন্য হয়ে বসে আছি।
শূন্য হয়ে বসে আছি– কথাটা একটা মাছির মতো উড়ে উড়ে বারবার এসে বসছে তার মাথায়। গুনগুন করছে, সুড়সুড়ি দিচ্ছে। সোহাগ বড় জ্বালাতন হল সারাদিন।
অ্যাই সোহাগ, কী হচ্ছে শুনি।
কী হচ্ছে?
আমার দাদাটিকে নাকি একদম পাত্তা দিচ্ছো না! তুমি কি চাও বিজুদা সাধু-টাধু হয়ে হিমালয়ে চলে যাক?
গেলে ভালই তো হত। আমার তো মনে হয় সব পুরুষেরই কিছুদিন হিমালয়ে গিয়ে সাধু হয়ে থেকে আসা উচিত।
ওমা! বলে কী রে?
.
৭৪.
স্বপ্নহীন এক দীর্ঘ ঘুমের পর সে জেগে উঠল মাটির গভীর তলদেশে। সমস্ত শরীর জুড়ে বেজে যায় ক্ষুধার মাদল। অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পায় না। দেখার দরকারও নেই তার। তার চঞ্চল চেরা জিব মুহুর্মুহু ছোবল দিচ্ছে বাইরের বাতাসকে। বার্তাবহ ওই জিব তার কাছে অনেক সংবাদ পৌঁছে দেয়। নিজের দীর্ঘ চিত্রল শরীরের আলস্য এবার ঝেড়ে ফেলতে হবে। ফের জীবন ধারণ, ফের অন্বেষণ, ফের পলায়ন আর আত্মগোপন, ফের আত্মরক্ষার্থে আক্রমণ, স্মৃতিহীন, বোধ ও বিবেচনাহীন সে তার শরীরের সংকেত পেয়ে ধীর গতিতে একটু একটু করে এগোয়। শীতঘুমের পর তার শরীরে এখনও জড়তা, গতি শ্লথ। দীর্ঘ ঈষৎ আঁকাবাঁকা গর্তের মুখে গেলে অস্পষ্ট দিবালোকের একটা চাকতি। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে সে নিঃশব্দে তার চারদিকটা দেখে।
ধানের উঁচু করা মরাইয়ের মাচানের তলায় বিষয়কর্মে ব্যস্ত ইঁদুরের যাতায়াত। শোনা যায় তাদের দুর্বোধ্য কিচকিচ শব্দ। একটি ইঁদুর গর্তের মুখ দ্রুত পেরিয়ে গেল, তার মুখের ওপর দিয়েই। সে তার ক্ষীণ মস্তিষ্কের সামান্য জৈব প্রয়োজনভিত্তিক সতর্কতায় তার চারদিকটা অনুধাবন করে নিল। নিয়তি তাড়িত দ্বিতীয় ইঁদুরটি সামান্য অনভিজ্ঞতাবশে এসে গিয়েছিল গ্রাসের দূরত্বে। খর দাঁতে কয়েক দানা ধান জিবোচ্ছিল সে। বিদ্যুতের গতিতে সে মুখে তুলে নিল তাকে। আঁকুশির মতো দাঁতে বিদ্ধ ইঁদুরটা প্রাণপণে চেঁচাল খানিক। তারপর কম্পিত, চমকিত ছোট্ট শরীরটা অতি কষ্টে প্রাণপণ আয়াসে সে গিলতে লাগল। দীর্ঘ উপবাসের পর এ কোনও সুস্বাদ নয় তার কাছে। এ শুধু প্রয়োজন। শুধুই প্রয়োজন। আর কষ্ট। মুখ থেকে গলা অবধি টেনে নিতেও কষ্ট। গলা থেকে পেট। তার আহার্য গ্রহণও এক ধৈর্যশীল, ক্লেশকর, ধীর প্রক্রিয়া। আহারের কোনও স্বাদ ও আনন্দ নেই তার।
সতর্ক ইঁদুরেরা সরে গেছে নিরাপদ আড়ালে। সে ঝিম ধরে পড়ে রইল অনেকক্ষণ। মাচার তলাকার আবহাওয়ায় ভ্যাপসা গরম। এই তার বহির্গমনের উপযুক্ত ঋতু। ক্ষীণ দৃষ্টির চোখে সে মাচানের বাইরে রোদের ঝকঝকে তলোয়ার দেখতে পাচ্ছে, আলো ও ছায়াকে দ্বিখণ্ডিত করে সে এখন অপেক্ষা করছে তার জন্য।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
.
চোখের কি আনন্দ হয়? মনে হয় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরই নিজস্ব আনন্দ, দুঃখ, বিষাদ ও উল্লাস আছে। হয়তো সবাই টের পায় না, কিন্তু সে পায়। ধীরেন জানে, অম্য সবাই তাকে ছিটিয়াল বলেই মনে করে। তা আছে বোধহয় তার মাথায় একটু ছিট। যে মাথায় কাজের চিন্তা নেই, যে মাথায় বিদ্যে নেই, সৎ কথা নেই, যে মাথা নিজের অস্তিত্বের বাইরে বাদবাকি দুনিয়াটা নিয়ে ভাবল না সে মাথায় ছিট হবে না তো কি? তা আছে একটু ছিট। দুনিয়াটাও তো বড্ড ছোট তার। আগে তবু এ-গাঁ ও-গাঁ গতায়াত ছিল, গত কয়েক বছর এই গাঁয়ের গাছেই বড় আটক পড়ে গেছে।
এই যে দুনিয়াটা দেখা যাচ্ছে এটা কিন্তু এক মাপের নয়, এক চৌহদ্দিও নয় এর। লোক বুঝে দুনিয়াও ছোট-বড় হয়। এই গৌরহরিদা ছিলেন, তাঁর দুনিয়াটা কি ধীরেনের মতো ছোট রে বাবা! কত লোকজন আসছে যাচ্ছে, এসোজন-বোসোজন, মক্কেল-মুরুব্বি, উকিল-মুৎসুদ্দি, জজ-ব্যারিস্টার নিয়ে বিরাট ব্যাপার। কত লোকের সঙ্গে নিত্যি যোগাযোগ, কত জীবনের কত কথা এসে যোগ হচ্ছে জীবনে, যেমনটা খালবিল নদীনালার জল এসে দরিয়ায় পড়ে, তবে না বারদরিয়ার অত বড় প্রসার। সেই তুলনায় ধীরেনের ডোবায় জলই নেই মোটে। ছোট্ট এঁদো-পুকুর বই তো নয়।
পাঁচটা লোকের সঙ্গে কথা কইতে আর শুনতে বরাবর বড্ড ভালবাসে ধীরেন। কিন্তু তার সঙ্গে কথা কইবে কে? কার গরজ! তাই সে গিয়ে সন্ধেবেলার দিকে গৌরহরিদাদার চেম্বারে এক কোণে চেপে বসে থাকত। কথা শুনত। মামলা-মোকদ্দমার কূট কথাই সব। তবু তাইতেও ভারী আনন্দ হত তার। কত কী শোনা হয়ে যাচ্ছে, জীবনে যোগ হচ্ছে কিছু। গৌরহরিদা কিছু বলত না। কথা শোনা আর লোকের মুখচোখ হাবভাব দেখা। নেশার মতো ছিল ব্যাপারটা। গৌরহরিদাদা মাঝে মাঝে তাকে জিজ্ঞেস করত এই নোকটাকে দেখে কিছু বুঝলি? কেমন গোলগাল ভালমানুষের মতো মুখ, দেখে বোঝা যায় যে আটটা খুন করেছে? বড় মাপের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করলে নিজের মাপটাও একটু একটু করে বাড়ে।