তার বোধ নেই, বুদ্ধি নেই, স্মৃতিশক্তি নেই, কর্মফল নেই, পাপ বা পুণ্যও নেই। তার আহার বিস্বাদ ও কষ্টকর, তার মৈথুন বাধ্যতামূলক এক প্রক্রিয়ার বেদনা, তার বিশ্রাম উদ্বেগাকীর্ণ। ওই যে বাহির তাকে ডাক পাঠাচ্ছে ওখানেও কোনও মুক্তি নেই তার। সেখানেও বাধা ও বিরুদ্ধতা। বন্ধুর তার গতিপথ, বিপদসংকুল। তবু সে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। তাকে জাগতেই হয়। সংকেতময় শরীরে সুনির্দিষ্ট বার্তা ঠিক পৌঁছে যায়। না তার স্বাধীন ইচ্ছাও কিছু নেই। তাকে চালায় ক্ষুধা, ভয়, মৈথুন। তাকে চালায় সংকেত ও পারিপার্শ্বিক। সে কখনও কোনও সৌন্দর্য দেখেনি, গান শোনেনি, স্থির জলে নিজের ছায়া দেখেও সে কখনও বোধ করেনি–ওই আমি।
আলস্য জড়ানো তার চোখ থেকে নেমে যাচ্ছে ঘুমের ভার। সে জাগছে। জাগছে।
.
তোমার কী খবর সোহাগ?
আমার! আমার কিছু এগোয় না। থেমে থাকে। আচ্ছা যা থেমে থাকে তাকেই কি স্থবির বলে?
আমি বাংলায় ভীষণ কাঁচা। তা বলে ইংরিজিতে পাকা নই। আমি সব বিষয়ে কাঁচা। তবু স্থবির মানে তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছ।
আমার হচ্ছে স্থবির জগৎ। আমার চারদিকে যা কিছু সব থেমে আছে। গাছপালা, মাটি, আকাশ। আসলে কিন্তু ওসবও কিছু থেমে নেই। আহ্নিক গতি আছে না?
সে আছে। তবু আমার নিজস্ব জগতে কোনও ঘটনা ঘটেই না। বড় জোর পুকুরের স্থির জলে একটা ঢিল পড়ল। ঢেউ ভাঙল, তারপর আবার নিঃঝুম।
আমি সবাইকে কী বলি জানো?
কী বলো?
বলি আমাদের সোহাগ অন্য রকম মেয়ে, আর পাঁচজনের মতো নয়। কথাগুলো এমন যে চমকে উঠতে হয়, ভাবতে হয়। ভারী আচমকা কথা সব। তাই না?
আসলে আমার যা মনে হয় তাই বলি। কেন যেন সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতেই পারি না।
এরকমই তো ভাল। মাঝে মাঝে এই যে আমাকে চমকে দিয়ে যাও তার রেশ কয়েকদিন থাকে। কথাগুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াঘাটা করি। কী খাবে বল তো আজ!
আমি বুঝি খেতে আসি?
আহা তাই বললাম বুঝি? গেরস্তবাড়িতে এলে কিছু মুখে দিতে হয়, এসব গা দেশের নিয়ম যে। আজকাল কেউ আসেও না, খায়ও না। উনি যতদিন ছিলেন বাড়ি গমগম করত। এসোজন বোলোজনের অভাব ছিল না। মাঝে মাঝে লোকের জ্বালায় বিরক্ত হয়েছি। আর বোধহয় তাই ভগবান শোধ নিলেন। এখন কেউ আসে না।
আচ্ছা উইডোদের খুব কষ্ট, না?
হ্যাঁ মা, বড্ড কষ্ট। আমার যেন ডান হাতখানাই নেই।
আমার পিসিরও খুব কষ্ট। তিনি উইডো নন, কিন্তু
ওর কষ্ট আরও বেশি। মুখ দেখলে বুঝবে না, ভিতরে কত জ্বালা আর অপমান, শুনি এখন ওর ব্যবসা খুব ভাল চলছে।
স্টিল শি ইজ নট হ্যাপি।
জানি। আগে আসত-টাসত, আজকাল বোধহয় সময় পায় না। সংসারে সবাই ভারী ব্যস্ত, আমারই কেবল দিন কাটে না। ওই দুখুরিই আমার সম্বল, আর কাজের লোকেরা। বোসো, আজ ক্ষীর দিয়ে মোয়া খাওয়াই তোমাকে।
উঠতে গিয়েও থমকায় বলাকা। তারপর হেসে বলে, বুঝেছি মিষ্টি জিনিস তো তোমার আবার পছন্দ নয়। কিন্তু কী জানো, এই বর্ধমানের লোকেরা মিষ্টির পোকা। তুমি কেন মিষ্টি ভালবাসো না বল তো!
আমার বোধহয় সুইট টুথ নেই।
আচ্ছা, তাহলে গরম চপ আনিয়ে দিচ্ছি। এখানে বেশ ভাল একটা খাবারের দোকান হয়েছে, বাজে জিনিস রাখে না। চমৎকার ভেজিটেবল চপ বানায়। খেয়ে দেখ।
তার চেয়ে বরং মোয়াই দিন।
বলাকা বসে পড়ে মোড়ায়, বলে, এ মেয়েকে নিয়ে যে কী করি। আমার বাড়িতে কত খাবারের আয়োজন। কত দুধ, ঘি, সবজি। কে খায় বল তো। বিলিয়েও শেষ করতে পারি না।
শুনেছি আপনি নাকি খুব ফ্রুগাল ইটার।
ও বাবা, তোমার ইংরিজি কি আমি বুঝি! তবে বোধহয় বলছ যে খুব কম খাই কি না। হ্যাঁ, এখন আর গলা দিয়ে ভাল খাবার নামতে চায় না। উনি খুব খেতে ভালবাসতেন। কিছু মুখে তুলতে গেলেই ওঁর কথা মনে পড়ে, আর খেতে ইচ্ছে হয় না।
আচ্ছা এটা কি অদ্ভুত নয়?
কোনটা অদ্ভুত?
এই আনক্যানি লাভ? এখন কেউ তো আপনার মতো ভাবতেই পারবে না।
কেন পারবে না! এরকমই তো হয়।
ইমপসিবল।
ইমপসিবল কেন?
আমার তো মনে হয় আপনাদের পৃথিবী আর নেই। এখন উই আর মোর প্র্যাকটিক্যাল অ্যান্ড মোর লজিক্যাল।
বলাকা হাসে, সে তো ঠিকই। চারদিকে তাই তো দেখছি মা। তা এ-ও বোধহয় ভাল। আমাদের যে বাড়তি ব্যাপারটা আছে তার জন্য তো কষ্টই পেতে হয়। তোমাদের আমলের সম্পর্কই বোধহয় ভাল। কে কার কড়ি ধারে তাই না?
একটুও হাসল না সোহাগ। বরং গভীর একটা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বলাকার মুখের দিকে। অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে বলল, হাউ ক্যান ইউ বি টোটালি মেসমেরাইজড বাই এ পারসন? আপনার অহংকার নেই? ব্যক্তিত্ব নেই? সেলফ রেসপেক্ট নেই?
বাবা রে বাবা! এ মেয়ের আজ হল কী? আজ আবার বুঝি মাথায় পোকা নড়ছে?
মাথা নেড়ে সোহাগ গম্ভীর মুখে বলে, না, আমি সত্যিই জানতে চাই। তর্ক করতে আসিনি। আমার সত্যিই আপনাকে দেখে অবাক লাগে।
এতে অবাক হওয়ার কী আছে বুঝি না বাপু। মায়েরা ছেলে-মেয়েকে যখন ভালবাসে তখন কি আর অহংকার, ব্যক্তিত্ব, সেলফ রেসপেক্ট কোনও বাধা হয়। পারলে প্রাণটা অবধি দিয়ে দেয়। তা সেই ভালবাসাটা তো মায়ের ভিতরেই থাকে, তাই না? তা সেরকম ভালবাসা যদি স্বামীর ওপর হয় তাহলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হল?
খুব চিন্তিতভাবে সোহাগ বলাকার মুখের দিকে চেয়ে রইল। চট করে জবাব দিল না। বেশ খানিকটা বাদে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপনি ভীষণ বুদ্ধিমতী, তাই আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। বাট দেয়ার ইজ এ মিষ্ট্রি ইন ইউ।