লোকটাকে তো তুমি ডিভোর্স দাওনি, না পিসি?
কী সব কাগজপত্র পাঠিয়েছিল সই করতে। আমি সই করেও দিয়েছি, তবু নাকি হয়নি। আমাকে খুব ধরেছিল যেন মামলা না করি।
করলে লোকটাকে বাইগামির চার্জে জেল খাটাতে পারতে।
লাভ কী বল। সে জেল খাটবে আর তার নতুন বউ চোখের জল ফেলে আমাকে শাপশাপান্ত করবে সেটা কি ভাল? আমার যা গেছে তা তো আর ফিরে পেতাম না।
তুমি খুব সংসার করতে ভালবাসো, না পিসি?
সন্ধ্যা লাজুক একটু হেসে বলল, এক একটা মেয়ে সংসার করতেই জন্মায়। তারা আর কিছু চায় না। কত মেয়ে গান গায়, লেখাপড়ায় বড় হয়, মিস ইন্ডিয়া হয়। ফিল্মস্টার হয়, মন্ত্রী হয়, তাদের ধরে বেঁধে বিয়ে দিলে বলে, জীবনটা নষ্ট হল। আবার আমার মতো কিছু আছে যারা আর কিছু হতে চায় না। শুধু সংসার নিয়ে মেতে থাকতে চায়।
তুমি যা করেছ পিসি তা যে সংসার করার চেয়ে অনেক বেশি।
জানি রে জানি। লোকে তাও বলে। কিন্তু তারা তো আমার বুকের ভিতরটা দেখতে পায় না। সেই জায়গাটা বড় ফাঁকা।
তুমি সেই লোকটার কথা এখনও ভাবো?
দেখ, সত্যি কথা বলতে কি তার মুখটা এখন ভাল করে মনেই পড়ে না। এ তো ঠিক একটা লোকের ওপর টান নয়। ওই লোকটাকে ঘিরে যা গড়ে উঠতে পারত সেই সংসারের ওপর টান। ওসব বুঝবি না তুই।
সোহাগ যে বুঝতে পারে না তা নয়। অন্তত এটুকু বোঝে পৃথিবীতে এক একটা মানুষ এক একটা অবসেশন নিয়ে জন্মায়। পিসির সঙ্গে তার কি যোজন যোজন তফাত? সেটাও মনে হয় না তার। মাঝে। মাঝে মনে হয় তার ভিতরেও একটা টোটাল সারেন্ডার আছে। অবশ্যই সেটা কোনও পুরুষমানুষের জন্য নয়। সেরকম প্রাণ সঁপে দেওয়ার মতো পুরুষমানুষ তো জন্মায় না। তবে কার জন্য হবে সেই সমর্পণ তা ভেবে পায় না সে।
পিসি বলে, আমার মতো হোস না রে। বড় কষ্ট।
আবার বিয়ে করতে পারো না কেন পিসি?
সন্ধ্যা হেসে বলে, বয়স বসে নেই রে। মনটাও বড় আঁচড়ে কামড়ে গেছে। এখন আর সেরকম হবে না। আরও কী জানিস? এখন আমার টাকা হয়েছে, কোমরের জোর হয়েছে, এখন কেউ বিয়ে করলে তার নজর থাকবে আমার টাকার উপর। এখন তো একটু একটু করে বুদ্ধিও খুলেছে আমার। আগের মতো বোকা তো নই। তাই স্বার্থপর দুনিয়াটাকে দেখতে পাই।
তাহলে তোমার কী হবে পিসি?
কী আবার হবে! অসুরের মতো খাটব, গুচ্ছের টাকা হবে আর তা দিয়ে কী করব ভেবে কূল পাব না। এখন এ-সংসারে আমার কত কদর হয়েছে দেখেছিস? সবাই তোতাই-পাতাই করে, বড় গলায় কেউ কথাটি কয় না। বিয়ে-ফেরত মেয়েমানুষের বাপের বাড়িতে কদর হয় দেখেছিস কখনও? হয় না। এ কদর আমার নয়, আমার টাকার। তলিয়ে ভাবতে গেলে বড় ঘেন্না আসে সবানার ওপর। তাই আর ভাবি না। আস্তে আস্তে একটা যন্ত্র হয়ে যাচ্ছি।
পিসির মানসিকতাটা সোহাগের অদ্ভুত লাগে। এই স্বাধীনভাবে খেটে এত রোজগার করছে, পাঁচজনের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে তা পিসির পছন্দ নয়। এর চেয়ে কী করে বেশি পছন্দের হয় একজন অচেনা পুরুষের সংসারে দাসীবৃত্তি করা এবং তার সন্তান ধারণ ও পালন করা? এবং সে পুরুষটাও নিতান্তই এক সাদামাটা সাধারণ মানুষ। এই বিস্ময়টা অনেক ব্যাখ্যা করেও মেটে না তার।
আজ রাতে পলকা তন্দ্রার মধ্যে বার বার সে পিসিকে দেখছিল। স্বপ্নই, তবে তেমন তাৎপর্যপূর্ণ কিছু নয়। একবার দেখল, আকাশে দিগন্তে ঘোর মেঘ করেছে, পিসি তাকে বলছে, ওই দেখ, আজ ভাসিয়ে নেবে। ফের দেখল, পিসি একটা ব্যাগে জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। সে বলল, কোথায় যাবে পিসি? সন্ধ্যা একটা পোস্টকার্ড তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ওই দেখ না, ডেকে পাঠিয়েছে। সে অবাক হয়ে বলে, কে ডেকে পাঠিয়েছে পিসি? সন্ধ্যা মুখ টিপে হেসে বলল, কে আবার। আমার যম। কিন্তু সে ডেকে পাঠালে তো না গিয়ে উপায় নেই রে। সে চেঁচিয়ে বলল, তুমি যেও না পিসি। পিসি বলল, তাও কি হয়?
ঘুম ও জাগরণের একটা মাঝামাঝি চৌকাঠে সে স্পষ্ট টের পেল সে কথা কইছে, মেয়েদের কোনওদিন কিছু হয় না কেন জানো? তাদের মনটায় একটা দাসখত লেখাই থাকে।
ঘুম ভেঙে সে চারদিকে চাইল। অন্ধকার। পুঞ্জীভূত অন্ধকার। তারপর স্বপ্নটার কথা মনে পড়ল। সেই লোকটা যদি আজ পিসিকে ডেকে পাঠায় তাহলে কি পিসি সত্যি সত্যিই সব ছেড়ে চলে যাবে নাকি? ভাবতেই ভারী রাগ হচ্ছিল তার, মধ্যরাতে, একা একা।
ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকের ছোঁয়ার মতো চুম্বনের সঙ্গে স্বাদ লেগে আছে। তার অধর ধর্ষিত হয়নি, নন্দিত হয়েছে। অন্ধকারে সে ভারী আরামে চোখ বুজল। মুখে একটু হাসি।
তারপর ভাবল, যদি সত্যিই কোনওদিন ডাকে লোকটা আর পিসি যদি সত্যিই চলে যায় তাহলেই বা ক্ষতি কী? যে যার নিজের জীবন তো নিজেই রচনা করবে। দাসীবৃত্তির মধ্যেই যদি কেউ আনন্দ পায় তো সে তাতে বাধা দেওয়ার কে?
ভেবে ফের একটু হাসল সোহাগ। একটু গরম লাগছে। আজকাল বেশ গরম পড়েছে এখানেও। পাখাটা কি চালিয়ে দেবে? না থাক। শেষরাতে হিম-টিম পড়লে তার অ্যালার্জি হবে।
.
তার শরীরেও সংকেত পৌঁছায়। নির্ভুল সংকেত। গভীর গুহার কবোষ্ণ অন্ধকারে তার শরীরে নানা স্পন্দন ছুঁয়ে যায়। ওঠো। জাগো। ধীরে, খুব ধীরে তোমার চোখ সইয়ে নাও জাগরণে। উপোসী, জীর্ণ শরীরের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে জমে থাকা আলস্য ও ঘুম ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছে তার। ক্লেশময় তার জীবন। শুধুই ক্লেশ, শুধুই ক্লান্তি, শুধুই পলায়ন।