কাদের?
সোহাগ আর বিজু! গাঁয়ে তো ঢি ঢি পড়ে গেছে। পাস না?
.
৭৩.
ঘড়ির দুটো কাঁটা হাতজোড় করে রাতের মতো বিদায় জানাচ্ছে সবাইকে। শুভরাত্রি বন্ধুগণ। রাত বারোটা।
আধো ঘুমের ভিতরেই একবার বাঁপাশ ফিরল সে। ফের ডানপাশ। অস্থিরতা, তার ঠোঁটে এখনও লেগে আছে একটি ভীরু চুম্বনের স্বাদ। ইট ওয়াজ এ কাওয়ার্ডলি কিস। আত্মবিশ্বাসহীন, কল্পিত, অগভীর। একটি চকিত চুম্বন থেকেও কত কী বুঝতে পারা যায়। বুঝতে পারা যায়, এই পুরুষটি আর কখনও কোনও মেয়েকে চুমু খায়নি। এই নীতিবাগীশ পুরুষটি তার কৌমার্য হারানোর ভয়ে জড়সড়, এবং চুম্বনের সময়ে তার ভিতরে চিৎকার করছে তার নানা সংস্কার। ফলে প্রাচীন পবিত্রতার শৃঙ্খল ঝনঝন করে বেজে উঠছে হাতে পায়ে। ফণা তুলছে পাপের ভয়। অসহায় পুরুষটি তাকে আলিঙ্গনও করতে পারেনি যথারীতি। গাঢ় শ্বাসে ভয়ের কাপন, বুকের টিপটিপ শব্দ শোনা যাচ্ছে দেহের বাইরেও। লজ্জায় চোখ বোজা, কোনও আশ্লেষ নেই, তীব্রতা নেই, অধিকারবোধ বা পৌরুষ নেই। শুধু অধরে অধরে কুশল বিনিময়ের মতো। ভিতর থেকে রাশ টেনে রাখল কে? কে বলল তো! বোধহয় ওর প্রাচীনপন্থী, রক্ষণশীল, গোঁড়া পূর্বপুরুষদের ডি এন এ নাকি জিন-এর পরম্পরা?
হাসি পেয়েছিল কি সোহাগের? মায়া হয়েছিল কি অসহায় পুরুষটির দিকে গোল গোল চোখে চেয়ে?
আশ্চর্যের বিষয় হল, সেসব হয়নি। সে ওই চকিত লঘু চুম্বনটিকে উপভোগ করেছিল। তার ঠোঁটে পুরুষদের অধরের নিষ্পেষণ কম হয়নি। প্যাশনেট কিস কাকে বলে তা সোহাগ জানে। কিন্তু আজকের ওই স্পর্শটির মতো এমন রোমান্টিক কোনওটাই ছিল না কখনও। ঠোঁটে স্বাদ লেগে আছে এখনও। বারবার তন্দ্রা ছুটে যাচ্ছে তার। বারবার পাশ ফিরছে। এত চঞ্চলতা কখনও বোধ করেনি সে।
জীবনে কোনও পুরুষের প্রয়োজন অনুভব করেনি বলেই এর আগে কখনও হাউড়ে পুরুষের হামলা একটুও ভাল লাগেনি তার। সোহাগ জানত তার জীবন অন্যরকম এবং একক। পুরুষ কেন, কোনও মানুষ না হলেও তার চলে। তার চারদিকের আবহমণ্ডলে নিত্যই সে কত সত্তার সন্ধান পায়। এই গাছপালা, বাতাস, পশুপাখি, জীবজন্তু তার সঙ্গে কত কথা কয়। পৃথিবীতে যত মানুষ জন্মেছে তাদের সকলের যেসব স্পন্দন আর চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে তারাও কাছে চলে আসে তার। সে টের পায় তাদের। কথাও বলে তাদের সঙ্গে। তার মা আর বাবার ধারণা তার মাথায় ছিট আছে, সে ভূতগ্রস্ত, প্রবলেম চাইল্ড। হয়তো তাদের ধারণা মিথ্যেও নয়। সে জানে সে স্বাভাবিক নয়। তার কথা শুনে অনেকেই অবাক হয়। আর তার ওই বিভোর নাচ দেখে কতজন বলেছে, একে ভূতে পেয়েছে।
হ্যাঁ, ভূতেই পায় তাকে। অনেক ভূত তার। আর ওই ভুতুড়ে জগৎই তার প্রিয়। ঘর সংসার আর মেয়েলিপনা তার একটুও সহ্য হয় না। তাই তার পুরুষে আসক্তিও জন্মায়নি কখনও।
পিসি সেদিন তার কথাবার্তা শুনে দুঃখ করে বলছিল, হ্যাঁ রে, তুইও কি শেষে আমার মতো হবি? এই যে একা একা টেনে নিচ্ছি নিজেকে এটা কি বেঁচে থাকা?
কেন পিসি, তুমি তো চমৎকার আছ! কত কাজ তোমার, কত রোজগার করছ।
সে তো ঠিকই রে। লোকে বলেও তাই। লোকে ভাবে, পয়সা হলেই হল, আর কিছুর দরকার নেই। কিন্তু পয়সা দিয়ে আমি কী করব বল তো! ব্যাঙ্কে আমার লাখ দুয়েক টাকা জমেছে, কিন্তু এ-টাকা দিয়ে কী করব যখন ভাবতে বসি তখন কূলকিনারা পাই না। কী করব বল তো টাকা দিয়ে? টাকা থেকে যদি নিংড়ে একটু আনন্দ পাওয়া যেত তাহলেও হত। আর কাজ! হাড়ভাঙা খাটুনিরও একটা আনন্দ হয় যদি সেটা কারও জন্য হয়।
তবে কী হলে ভাল হত পিসি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যা বলে, ঘরসংসার হলে, স্বামী, ছেলে মেয়ে এসব থাকলে তখন খেটে আনন্দ।
তোমার কেবল এক কথা, পিসেমশাইকে খুব ভালবাসতে বুঝি?
তা নয়, ভাল করে চোখের দেখাই তো হল না, ভালবাসাটা হবে কেমন করে বল। সেরকম ভালবাসা নয়, এ হল অন্যরকম। কীরকম জানিস? বিয়ের পরই মনে হল, এ আমার নিজের মানুষ। এই আমার সম্বল, আমার আশ্রয়, আমার ইহকাল পরকাল, দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের ভিড় থেকে এই যে একজন উঠে এসে গলায় মালা পরিয়ে দিল, অমনি তার সঙ্গে বাদবাকি মানুষের তফাত হয়ে গেল।
এটাই তো প্রেম!
মাথা নেড়ে সন্ধ্যা বলে, না রে, তোরা যাকে ভালবাসা বলিস এ তা নয়, তার চেয়েও বেশি। ও তুই বুঝবি না। আমি তাকে কম খুশি করতে চেষ্টা করেছি? বাইরে থেকে এলে পা থেকে জুতো খুলে দিয়েছি, বাতাস করেছি। তার যত্নের এতটুকু ত্রুটি রাখিনি। তাকে পেয়ে যেন আমি উথলে উঠলাম, ডবল হয়ে গেলাম। আর তাতেই সে হাঁসফাঁস হয়ে গেল কিনা কে জানে। হয়তো অত আদেখলেপনা দেখেই বিমুখ হল। হয়তো সইল না।
যাই বলল পিসি, লোকটা কিন্তু আনগ্রেটফুল ছিল।
তা তো ছিলই। সে কি আর ছিল না। তবে আমি তো তার দোষগুণ বিচার করে দেখিনি, এমনকী সুন্দর না কুচ্ছিত সে কথাও মনে হয়নি।
লোকটা কি হ্যান্ডসাম ছিল পিসি?
আরে না। মাঝারি খেকুড়ে চেহারা, রোগা, রংটাও শ্যামলা। মুখের ছিরি ওই একরকম। তুই বুঝবি না, লোকটা বড় কথা নয়, সে হয়তো পছন্দ করার মতোও নয়, তবু তাকে নিয়েই আমার যে মাতামাতি সেটা হল আমার ব্যপার। একটা মানুষকে পেয়েছি, এবার তাকে ঘিরেই লতিয়ে উঠব।