আরে না না, কালী কি আমার মতো পারে?
আমিও তো তাই বললাম জগুকে। দুজনে একটু ঝগড়াও হল। পান্নাদি সেদিন বলছিল, সন্তোষী মা নাকি কালীর চেয়েও ভাল। সত্যি ঠাকুর?
ওরে, আমিই তোকে সব দেবোখন।
দিচ্ছ কোথায়? এরপর কিন্তু আমি ঠিক একদিন কালীভক্ত হয়ে যাব। তখন বুঝবে।
রাগ করিসনি বাপধন। আর ভুল হবে না।
হ্যাঁ ঠাকুর, তোমাকে যে বলেছিলাম পান্নাদির সঙ্গে আমার দাদার একটু ভাবসাব করে দাও, দিলে না তো!
দিইনি বুঝি! তা সে আর কী করা যাবে।
ওদিকে যে অর্ঘ্য ব্যানার্জির সঙ্গে পান্নাদির ভাব হয়ে গেল!
সে আবার কে রে?
পান্নাদির দাদার বন্ধু। দেখনি বুঝি? কী সুন্দর লম্বা পানা চেহারা কম্পিউটার ইনজিনিয়ার। এই তো বড়দিনের ছুটিতে এসে ঘুরে গেল। তারপর গেল হপ্তায় এসেছে। খবর আছে এ-হপ্তায়ও আসবে। খুব নাকি বড়লোকের ছেলে। তুমি কিন্তু কিচ্ছু পারো না ঠাকুর।
চোখ বুজেই মরণ টের পেল। শিবঠাকুর খসখস করে জটার নীচে মাথা চুলকে নিল। তারপর বলল, সব কি আর খেয়াল থাকে রে। চারদিকে কত কী হুটহাট হয়ে যায়।
ও ঠাকুর, তোমাকে উকুনে খাচ্ছে নাকি? মায়ের কাছে উকুনমারা তেল আছে, চুরি করে এনে দেব?
উকুনমারা তেলও আছে নাকি? দিস তো বাবা, কতকালের পুরনো জটা, উকুন তো হবেই।
পান্নাদির মুখখানা আজকাল খুব ঝলমল করে আর একটা লালচে আভাও দেখতে পায় মরণ। সেদিন জ্যাঠাইমার জন্য ডাব পাড়তে গাছে উঠেছিল মরণ। আজকাল গাছে ওঠা বারণ হয়েছে তার। বাবা হুকুম দিয়ে গেছে, এই বান্দর, গাছে উঠলে কিন্তু চ্যাঙ্গাব্যাঙ্গা কইরা ঠ্যাঙ্গামু। তবু চুরি করে কারও কারও কথায় এখনও গাছে-টাছে উঠতে হয় তাকে।
ডাব পেড়ে যখন নেমে এল তখন দেখল, পান্নাদির বাড়িতে খুব হই-চই। কারা সব এসেছে। বাইরের ঘরে হাসাহাসি হচ্ছে খুব।
উঁকি মেরে তখনই ছেলেটাকে দেখতে পেল মরণ। তার দাদাও সুন্দর বটে, কিন্তু এ আরও সুন্দর। কী লম্বা আর ফর্সা। আর মুখখানা অনেকটা ফিল্মস্টারের মতো। মরণ বেশি সিনেমা দেখেনি। টিভিতে একটু আধটু। অন্যদের মতো সে ফিল্মস্টার বেশি চেনে না। তবে জানে ফিল্মস্টাররা খুব সুন্দর দেখতে হয়।
পরদিন সে পান্নাদিকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ, পান্নাদি, এই লোকটা কে এসেছিল তোমাদের বাড়িতে? সুন্দরপানা, লম্বা?
পান্নাদির মুখটা রাঙা হয়ে গেল হঠাৎ। মুখে টেপা একটু হাসি।
ও দাদার বন্ধু। অর্ঘ ব্যানার্জি।
ফিল্মস্টারের মতো দেখতে, না?
আছে একরকম।
আগে ওসব বুঝতে পারত না মরণ। আজকাল পারে।
আর বুঝতে পারে বলে তার মোটেই ভাল লাগে না। কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়। তার এত বুঝতে পারার দরকারই ছিল না।
পান্না বলল, তোর খুব উঁকিঝুঁকি দেওয়ার অভ্যাস, না? একদিন তোর মাকে বলে দেব।
বাঃ, উঁকিঝুঁকি হল বুঝি? আমি জ্যাঠাইমার জন্য ডাব পেড়ে আনলাম না? তখন দেখলাম তো!
পান্না হাসছিল, খুব সুন্দর লাগল বুঝি তোর?
খুব। তোমার লাগেনি?
মুখটা একটু বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের ভাব করে পান্না বলল, দেখতে খারাপ নয়। তবে বড় নিজের গল্প করে। অহংকার, বুঝলি?
না, ওসব বুঝতে পারে না মরণ। এখনও সব আবছায়া পরিষ্কার হয়ে যায়নি তার কাছে। তবে ধীরে ধীরে প্রাপ্তবয়স্কদের জগতের পর্দা একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে। আর যন্ত্রণা হচ্ছে তার। ভাল লাগছে না।
আজকাল সে কমবয়সি মেয়েদের দিকে তাকায়। তার নানারকম অদ্ভুত ইচ্ছে হয়। কেন এসব হয়? কেন এসব হতেই হয়?
জগুও সেদিন বলছিল, অনেক ব্যাপার আছে, বুঝলি?
কী ব্যাপার?
জগু হেসে বলে, একে একে দুই। মানে জানিস?
জানে, না জেনেও মরণ জেনে গেছে। এসব কথার মধ্যে যে একটা আমিষ গন্ধ পায়। তবে তার দুনিয়া যে পালটে যাচ্ছে, এটা খুব সত্যি কথা। শরীরে অনভিপ্রেত উত্তেজনা, মনের মধ্যে আনচান।
জগু কিছু অসভ্য কথা শুনিয়েছিল তাকে। শুনে তার কান গরম হয়ে গিয়েছিল। আবার খারাপও লাগছিল না।
বিজুদার দোতলার ঘরের ঘুলঘুলিতে আর আলমারির মাথায় চড়াইপাখি বাসা বেঁধেছে। সেখান থেকে একটা চড়াই-বাচ্চা পড়ে গেছে মেঝেয়। সেটা এখনও উড়তে শেখেনি। ও বাড়িতে ভয়ংকর সব বেড়ালের উৎপাত।
বিজুদা তাকে ডেকে একদিন বলল, হ্যাঁ রে, একটা ব্যবস্থা করতে পারিস? তুই তো আগে খুব পাখির বাচ্চা চুরি করতি গাছে উঠে। এই বাচ্চাটাকে সাবধানে বাসায় তুলে দিতে পারবি না?
খুব পারবে মরণ। চড়াই বাচ্চা তুলতে গিয়েছিল বিকেলবেলা। রবিবার ছিল, মনে আছে। গিয়ে দেখে সোহাগদি আর বিজুদা কম্পিউটারের সামনে জোড়া লেগে বসা। দুজনেরই চোখ পর্দায় ধ্যানস্থ। তাকে দেখে কেউ চমকাল না। বিজুদা শুধু বলল, ছাদে ফোন্ডিং মইটা আছে। নিয়ে আয়। পাখির ছানাটা বোধহয় খাটের তলায় ঢুকেছে।
পাখির ছানাকে তার বাসায় স্থাপন করতে যেটুকু সময় লাগল তার, দেখল, দুজনে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। কিছু করছেও না। মনিটরের পর্দায় চোখ রেখে বসে আছে। সেখানে কীসব লেখা আর ছবি-ছক্কর ফুটে উঠছে।
রায়বাড়ির জ্যাঠাইমা ডেকে সেদিন তাকে দুটো গন্ধলেবু আর একটা বাতাবি দিল। গন্ধলেবু মরণের বাবা খুব ভালবাসে। বাতাবিটা কেউ খাবে না। এ বাড়ির বাতাবি জোঁদো টক। আগে টক-মিষ্টির তফাত ছিল না মরণের কাছে। আজকাল হয়েছে।
জ্যাঠাইমা গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, হাঁ রে, ওদের একসঙ্গে দেখতে পাস?