সে তো ঠিক কথা, তবু মনটা মানতে চায় না।
মনের বালাই বেশি থাকলে মাথার গণ্ডগোল হইব, বোঝলা? বিষয়-আশয় আছে, পোলাপান আছে, সংসারধর্ম আছে, এইসবে মনটা সই করতে পার নাই? দিদি-দিদি কইরা হাদাইয়া মর ক্যান?
হ্যাঁ গো, তোমাকে একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না?
আরে কও, কও, সব কইয়া ফালাও, মনটা পরিষ্কার কর।
লোকে বলে আমি নাকি তোমার আসল বউ নই। আইনের চোখে নাকি আমার কোনও দাম নেই। সত্যি?
আইন? আইন তো দেখি সারাক্ষণই চক্ষু বুইজ্যা ঘুমাইয়া আছে। হ্যায় চাইলে স্যান কোনটা গতিক কোনটা বেগতিক তা বোঝন যাইব। আমরা কি আইনের লাগুড় পাই?
লোকে তো বলে দুটো বউ থাকা বে-আইনি।
লোকে মিছা কয় না। কিন্তু সরকারের যেমন আইন আছে তেমন আমাগরও কিছু কয় কর্তব্য আছে। আমার তো মোটে দুগা বিয়া, আগে তো মানুষ গণ্ডায় গণ্ডায় করত।
আগের দিনে ওসব হত, আজকাল তো হয় না।
আজিকাইল আরও খারাপ কিছু হয়। দুইটা-তিনটা বিয়া হয় না বইল্যা কি সব সাধুপুরুষ হইয়া বইস্যা আছে নাকি। চোরায়-গোপ্তায় কত কী হয়। বিয়া করতে বুকের পাটা লাগে, বোঝলা? গৌরহরি উকিল আমার পিঠ চাপড়াইয়া যে কইছিল তুমি বাপের ব্যাটা আছো হে সে তো এমনি কয় নাই।
তাহলে কি আমি তোমার সত্যিকারের বউ?
মিছা বউ তো আর না। এই লইয়া ধন্ধে পড়ছ নাকি?
চোখে জল আসছিল বাসন্তীর। আঁচলে চোখ মুছে বলল, যখন লোকে বলে আমি তোমার মিথ্যে বউ তখন আমি সইতে পারি না। দিদিকে তখন আমার ভারী হিংসে হয়।
রসিক সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখে বলল, আইন মানুষই বানায়, মানুষই বদলায়। যখন যেমন দরকার। আইন লইয়া ভাববা না, সংসার লইয়া ভাব।
সব প্রশ্ন যে জল হয়ে গেল তা নয়; তবে দম ধরল বাসন্তী। বুক ঠান্ডা হল না, তবে জ্বলুনি একটু কমল। রসিকের জুলপিতে একটু পাক ধরেছে। শরীর অবশ্য সেই আগের মতোই মেদশূন্য এবং কঠিন ও পুরুষালি। কিন্তু রসিক আর নবীন যুবক নয়। বাসন্তীর চেয়ে বছর পনেরোর বড়। বাসন্তীর বয়সও তো বসে নেই। মেয়েদের বয়স রেলগাড়ির মতো দৌড়য়। তাদের বয়স হয়ে যাচ্ছে। তারা এখন মোহনার দিকে। এখন আর সম্পর্কের হেরফের হয় না।
রাতে দুজনের আদর সোহাগ হল খুব।
বাসন্তী বলল, এবার কী হবে গো? ছেলে না মেয়ে?
পোলা।
কেমন করে বুঝলে?
ওই যে কয় মাইয়ার মা সুন্দরী, পোলার মা বারী। তোমার চেহারাখান ভাল দেখি না। ঝটকাইছে।
.
তার যে ভাই হবে একথা সে মায়ের কাছেই শুনেছে। শুনে যে খুশি হয়েছে তা নয়। বরং তার ভারী লজ্জা করে। কারণ, কী করে কোন প্রক্রিয়ায় ভাইবোন হয় তা সে আগে জানত না, সদ্য জেনেছে। আর সেটা এক ভীষণ অসভ্য কাজ। সেই অসভ্য কাজটা তার মা আর বাবা করেছে এটা ভাবতেই তার কেমন যেন মনটা বিকল হয়ে যায়, কান্না পায়। ভগবান, কেন এই বিচ্ছিরি নিয়ম। ওসব অসভ্যতা ছাড়া এমনিতে কোনও নিরাপদ প্রক্রিয়ায় কি ভাইবোন হতে পারে না?
দুপুরবেলায় তার প্রিয় গাছের তলায় অদৃশ্য শিবঠাকুরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে সে। বুকে অভিমান, লজ্জা, ঘেন্না।
ঠাকুর, এসব অসভ্য নিয়ম তুমি বদলে দাও। ওভাবে কেন ভাইবোন হবে ঠাকুর? ছিঃ ছিঃ ভাবতেও যে লজ্জায় মরে যাই। ওভাবে কি আমিও হলাম ঠাকুর? দোহাই তোমার, এ নিয়ম পালটে দাও, তার চেয়ে বরং আকাশ থেকে নেমে আসুক শিশুদের বীজ। বৃষ্টির মতন। জল পড়ুক মায়েদের মাথায়, গায়ে। শিশু সঞ্চারিত হোক মাতৃগর্ভে। না হয় তো অন্য কিছু হোক, অন্য কোনও প্রক্রিয়ায়। ওই লজ্জাহীন বিচ্ছিরি কাজের ভিতর দিয়ে নয়। দোহাই ঠাকুর…
তার ভালমানুষ শিবঠাকুর সব তাতেই রাজি। হাই তুলে বলল, তাই হবে রে বাবা, এখন থেকে তাই হবে।
বর দিলে তো?
দিলাম।
বরটাকে ঠিক বিশ্বাস হয় না মরণের। বর দিলে হবে কী, ভোলাবাবা সব আবার ভুলে মেরে দেয়। শিবঠাকুরকে নিয়ে ওইটেই মুশকিল। এমনিতে মানুষটা বড্ডই ভাল, কারও সাতেপাঁচে নেই। আপনমনে ঝুঁদ হয়ে থাকে। মরণ সেই জন্যই শিবঠাকুরকে এত ভালবাসে। কিন্তু শিবঠাকুরের ভুলো মনের জন্য তার দেওয়া বরগুলো মোটেই ফলতে চায় না। তিনটে-চারটে বরের মধ্যে একটা হয়তো ফলল, বাকিগুলো ফলল না। এতে ভারী মুশকিল হয় মরণের। বরগুলো ফললে কত কী হয়ে যেত এতদিনে।
আমি হলাম মরণকুমার সাহা, আমার কথা তোমার মনে আছে তো ঠাকুর?
হ্যাঁ হ্যাঁ, তোকে আবার মনে থাকবে না।
তুমি তো ভীষণ ভুলে যাও। এই যে সেদিন পল্টন আমার জলছবিগুলো কেড়ে নিল তুমি কিছু করলে না। কী ভাল সব জলছবি মাকে দিয়ে বাবাকে বলিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়েছিলাম। বদলে ভিডিওগেমটা দেওয়ার কথা ছিল পল্টনের। দিল তা? তোমাকে কত করে বললাম, পল্টনের হাতটা যেন ভেঙে দিও ঠাকুর। বাঁ হাতটা ভাঙলেও হবে। শুনলে সে কথা?
বাঁ হাত বলেছিলি, না ডান হাত সেইটেই তো গুলিয়ে ফেললুম রে। তাই আর ভাঙা হয়নি বটে।
তাহলে আমার গায়ে আরও জোর দাও না কেন? একাই যাতে দশ জনকে ঠান্ডা করে দিতে পারি।
কেন, তোর জোর কি কম?
কম নয়, কিন্তু আর একটু হলে ভাল হয়। পল্টন আর গদাইকে খুব পেটাতে ইচ্ছে করে যে। দুটোই পাজি।
তুই পাজি নোস তো।
আমিও আছি একটু, তবে ওদের সঙ্গে পারি না।
ঝগড়া কাজিয়া কি ভাল? ভাব করে নে না।
তুমি কিন্তু কিচ্ছু পারো না শিবঠাকুর। জগু কী বলেছে জানো? ও নাকি মা কালীর কাছে যা চায় সব পায়। মা কালী নাকি তোমার চাইতে অনেক ভাল। সত্যি ঠাকুর?