.
৭২.
সিঁড়ির শেষ ধাপটায় ঠিকমত পা রাখতে পারেনি বাসন্তী। খন্দের মতো ফাঁকায় পা পড়ে শরীর টাল খেয়ে গেল তার। চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে দুর্বল শরীর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল নীচে, বারান্দার শানের ওপর। সতর্ক ও তৎপর রসিক একটা লাফ দিয়ে গিয়ে জাপটে না ধরলে বাসন্তীর সর্বনাশ লেখা ছিল কপালে।
দেখছ কাণ্ড! ওই রকম আথালি-পাথালি হইয়া লামতে আছে।
কিছুক্ষণ বাসন্তীর হুঁশ ছিল না। রসিক পাঁজা করে ধরে তাকে বসাল বারান্দায় তারপর নরম গলায় বলল, ভয় নাই, কিছু হয় নাই তোমার। চক্ষু মেইলা চাও তো!
বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিল বাসন্তী হাঁ করে। প্রথমটায় কথা বলতে পারল না। তারপর হাঁফ-ধরা গলায় বলল, কী হয়েছে গো আমার?
কিছু হয় নাই।
দু হাত বাড়িয়ে স্বামীর দুখানা হাত চেপে ধরে বলল, আমি কি রাখতে পারব ওকে? ও পেটে আসার পর থেকেই কীসব হচ্ছে বলো তো! এত ভয় করে আমার!
রসিক হেসে বলল, ভয়ই তো তোমারে খাইল। এত ডরানের কী আছে? লও, উপরে লও তো, তোমার কথা শুনি।
বাসন্তী এবার একটু স্বাভাবিক বোধ করছে। এই একটা লোক কাছে থাকলে তার ভয় ভীতি থাকে না, বলভরসা হয়। কিন্তু এ-মানুষটা কাছে না থাকলেই সে যেন কেমনধারা হয়ে যায়, পায়ের নীচে যেন মাটি থাকে না।
বাসন্তী সামলে নিয়ে বলল, তুমি ওপরে গিয়ে বোসো, আমি চা নিয়ে আসছি।
থোও ফালাইয়া চা; অখন উপরে লও। এক কাপ চা মুক্তাই বানাইয়া আনতে পারব।
ও বুঝবে না। গুচ্ছের চিনি দিয়ে ফেলবে, লিকার কড়া হয়ে যাবে। দামি চা নষ্ট করবে। আমার শরীর এখন ঠিক আছে, পারব।
তা হইলে আমি নীচেই বসি। চা লইয়া উপরে উঠতে গিয়া আর এক বিপত্তি বাধাইবা।
কিছু হবে না।
চা নিয়ে এসে বাসন্তী দেখল, রসিক গভীর চিন্তায় মগ্ন। হাত বাড়িয়ে চা নিয়ে বলল, বোঝলা, আমি একটা কথা ভাবলাম।
কী কথা?
যতদিন প্রসব না হইতেছে ততদিন তোমারে আর দোতলায় থাকতে হইব না। আইজই ব্যবস্থা করতাছি। কিছুদিন আর সিঁড়ি ভাঙানোর কাম নাই।
তাই বুঝি হয়! আমার সব যে ওপরে। পোশাক-আসাক, টাকাপয়সা, গয়নাগাটি।
আরে দূর। বিলিব্যবস্থা করতে লহমাও লাগব না।
অত ভাবছ কেন? তোমার গলা শুনে হঠাৎ দিশাহারা হয়ে নামতে গিয়ে পা-টা ফসকে গিয়েছিল। ও কিছু না। এবার থেকে সাবধান হব।
আমার গলা শুইন্যা তোমার ওইরকম বেজাহান হওয়ার কী হইল? আমি কোন বিলাত থিক্যা আইলাম?
লজ্জা পেয়ে বাসন্তী মুখ নামিয়ে বলে, তোমার কথা খুব বোধহয় ভাবছিলাম। তাই হঠাৎ
রসিকের কঠোর মুখখানা হঠাৎ স্নিগ্ধ হয়ে গেল।
সে একটু হেসে বলল, আমি কোন নূতন গোসাঁই আইলাম যে আমার কথা ভাবছিলা, আবার দুঃস্বপ্ন দ্যাখছ নাকি?
দুঃস্বপ্ন! সে তো রোজ দেখি। তুমি যদি এ সময়টায় কিছুদিন আমার কাছে থাকতে! তুমি থাকলে কিছু হয় না।
তা হইলে যে কারবার লাটে উঠব। খাইবা কী? হরিমটর?
সেই তো ভাবি। কী যে করি।
ঠাকুর-দ্যাবতায় তো তোমার খুব বিশ্বাস! না! তাগো ডাকোনা ক্যান?
তারা বুঝি আমার ডাকে সাড়া দেয়? আমি পাপী না?
এইটা আবার কী কথা! তুমি পাপী হইলা ক্যামনে?
সে আছে।
পাপীরই তো ভগবানরে বেশি দরকার। কী কও? পতিতপাবন না কী জানি কয়।
সে ঠিক। তবে আমার ওপর কেন যেন চটা।
রসিক একটু হাসল। তারপর কোমল গলায় বলল, ভগবান যদি চেইত্যা যায় তবে হ্যায় আর ভগবান থাকে কেমনে?
হ্যাঁ গো, তুমি বুঝি ভগবান মানো না?
মানুম না ক্যান? মাল বেইচ্যা খাই, ভগবান না মাইন্যা উপায় আছে? আমার গদিতে তো যাও নাই, ইয়া বড় নাদাপ্যাটা গণেশঠাকুর দেখতে পাইবা। সকালে বিকালে পুরুত আইয়া মালা চড়াইয়া যায়।
খুব ভাল। আমাকেও একটা ভাল দেখে গণেশঠাকুর এনে দিও তো। আমার একটা পটের গণেশ আছে, কিন্তু ছবিটা বড্ড আবছা। গণেশবাবার আহ্লাদী ভাবটা নেই। এনে দেবে?
দিমুনা ক্যান? আইজকাইল গণেশবাবার প্র্যাকটিস খুব ভাল। মূর্তিও মেলা পাওয়া যায়।
হ্যাঁ গো, দিদি কার ভক্ত জানো?
ক্যান কও তো!
এমনিই। মনে হয় দিদি খুব কালীর ভক্ত। তাই না?
বুঝলা কেমনে?
বলব? রাগ করবে না?
রাগের কী?
একদিন স্বপ্নে দেখলাম দিদি এলোচুলে বসে কালীপুজো করছে। কালীমূর্তির চোখদুটো যেন জীবন্ত!
মাইয়ালোকে পুজা করে নাকি?
স্বপ্নে দেখলাম, সত্যি নাও হতে পারে। স্পষ্ট শুনছিলাম দিদি বিড় বিড় করে মন্ত্র বলছে।
হ্যায় যে কার ভক্ত তা জানি না। তবে ঠাকুরঘরে সবরকমই আছে। শিব-দুর্গা কালী-জগদ্ধাত্রী, সন্তোষী মা সব।
দিদি বুঝি খুব পুজো-টুজো করে?
তোমারে আইজ দিদিতে পাইছে ক্যান?
একটা দীর্ঘশ্বাস পেলে বাসন্তী বলল, আমি ভাবি কী, আমি কি তার নখের যুগ্যি?
না হইলে কি গলায় দড়ি দিতে হইব নাকি? তাইন তাইনের মতো, তুমি তোমার মতো। তার লগে তো তোমার কাইজ্যা নাই।
আছে বইকী গো। মুখে ঝগড়া নেই ঠিকই, কিন্তু আমি তো দিদির চক্ষুশূল। তাই না বলো!
নাকি? ভাল। কারও চক্ষু শূলাইলে কী করবা? গিয়া তো আর তার চোখে মলম লাগাইতে পারবা না।
পায়ে তো পড়তে পারতাম।
খামাখা তার ঠ্যাং ধরতেই বা যাইবা ক্যান? তুমি তো কিছু দোষ কর নাই, করছি স্যান আমি। তুমি ঠ্যাং টানাটানি করলে লাভ কী?
আমারও কি দোষ নেই?
খুচাইয়া খুচাইয়া দোষ বাইর করনের কামটা কী? তুমি হইলা ঢ্যাপের দলা। মায়ে বাপে ধইরা বাইন্ধ্যা আমার লগে বিয়া দিয়া দিছিল। তোমার তো তাতে হাত আছিল না।