মরার কথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের নিরালা যখন একরকম সুখে ভরে উঠছিল তখনই চিৎকারটা শুনতে পেল সে। বুড়ো মানুষের গলায় বাপ রে! শোওয়া অবস্থাতেই শরীরটা গড়িয়ে উপুড় হয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সে দেখতে পায়, ধীরেন কাষ্ঠ দাঁড়িয়ে। হাতে ধরা ধুতির খুঁট, ছড়ছড় করে ধুতি ভিজিয়ে পেচ্ছাপ পড়ে যাচ্ছে পায়ের লালচে রঙের ক্যাম্বিসের জুতোর ওপর। এঃ মা!
লজ্জায় মুখটা সরিয়ে নিয়ে পান্না বলে, কী হয়েছে জ্যাঠামশাই?
সাপ।
কামড়েছে নাকি?
না, আর একটু হলেই কামড়াত।
কোথায় সাপটা?
ধীরেন কাষ্ঠ হাত তুলে লাকড়িঘরের দিকে দেখিয়ে বলল, ওইখানে।
.
ঘোষবাড়ির সুপুরিগাছের ডগায় উঠে মরণ নানা দৃশ্য দেখছিল। আফ্রিকার ম্যাপের মতো দেখতে একটা বড় মেঘ একটা শ্রীলংকার মতো ছোট মেঘকে আস্তে আস্তে গিলে ফেলল আর তারপর দুটিতে মিলে হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া। আর দেখল, নয়নদের বাড়ির উঠোনে শীতের লেপকাঁথা বের করে চাটাই পেতে রোদে দেওয়া হয়েছে। আর চাটুজ্যেবাড়ির গৌরহরিদাদুর শ্রাদ্ধের সাদা ম্যারাপ ফুলে ফুলে উঠছে হাওয়ায়। আর সন্ধ্যাদির বাড়ির দোতলার গ্রিল দেওয়া বারান্দায় আজও সেই ফুটফুটে মেয়েটা উদাসভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আর সন্ধ্যাদির উদুখলের ধুপ ধুপ ধুপ ধুপ শব্দটা পৃথিবীর হৃৎপিণ্ডের শব্দের মতো উঠে আসছে। গাছের ঘষটানিতে বুকের নুনছাল উঠে গিয়ে জ্বালা করছে। ঘোষ জ্যাঠাইমা তাড়া দিচ্ছে, ও মরণ, তোর হল? তাড়াতাড়ি কর বাবা। সুপুরিগুলো গোছ করে রেখে শ্রাদ্ধবাড়িতে যাব যে!
মাঝে মাঝে এত আনমনা হয়ে যায় বলেই তার বিপদ। একবার আমগাছ থেকে পড়ে বাঁ হাত ভেঙেছিল তার। তবু ওই আনমনা হওয়া তাকে ছাড়ে না। পেকে ওঠা সুপুরির গোছ মাত্র দুটো কেটে ফেলেছে, তারপর কেমন সব ভুলে বিস্ময় ভরা চোখে দেখছে তো দেখছেই। আর নানা কথার ভুড়ভুড়ি উঠছে মনের মধ্যে।
হঠাৎ সাপে ধরা ব্যাঙের ডাকটা কানে এল তার। কী করুণ আতাঁরব! কঁ-অক, কঁ-অ-ক। হাতের দা-টা ঠাঙাৎ করে নীচে ফেলে দিল সে। দু পায়ে দড়ির ফাঁস ছিল, নাড়া দিয়ে সেটাও ফেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে লাগল সে।
ও মরণ, নামছিস যে! পাড়বি না?
দাঁড়ান জ্যাঠাইমা, আগে সাপটাকে মারি।
সাপ মারবি কী রে? কোথায় সাপ?
আছে।
সে জানে মানুষ বিপদে পড়লে যে বিপদসংকেত পাঠায় তাকে বলে এস ও এস। সেভ আওয়ার সোল। আমাদের প্রাণরক্ষা করো। ব্যাঙটাও সেই বার্তা পাঠাচ্ছে চারদিকে। জলে জঙ্গলে, ঘাটে আঘাটায় এমনই সব তুচ্ছ নানা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, মানুষ টেরই পায় না। কিন্তু ব্যাঙটা কার কাছে পাঠায় ওই বিপদসংকেত? ওর কি ভগবান আছে? নাকি আছে কোনও কমিউনিটি? অন্য ব্যাঙেরা কি এসে বাঁচাবে ওকে কখনও? তবে ও কাকে ডাকে? মরণ জানে সাপের মুখ থেকে ব্যাঙটাকে ছাড়িয়ে নিলেও বাঁচবে না। কিন্তু সাপটাকে যে তার মারতেই হবে।
শেফালী বউদি বলে, তুই কেমনধারা ছেলে রে? প্রজাপতির পাখা ছিঁড়ে দিস, চড়াইপাখির বাসা ভাঙিস, ফড়িং-এর পায়ে সুতো বেঁধে ওড়াস, সাপ মারিস! এমন পাষাণ কেন রে তুই?
সে ভাল ছেলে নয়, সে জানে।
গাছ থেকে নেমে দুটো ইটের ঢেলা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটছিল মরণ। ভটচাযবাড়ির লাকড়িঘরের সামনে ধীরেন জ্যাঠার মুখোমুখি।
ধীরেন কাষ্ঠ বলল, দেখ বাবা কী কাণ্ড। শ্রাদ্ধবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি, পথে এই বিপত্তি।
এঃ জ্যাঠামশাই, আপনি যে পেচ্ছাপ করে ফেলেছেন।
বুড়ো বয়সে কিছুই কি আর বশে থাকে রে বাবা। আর সাপটাও এমন ফোঁস করে উঠল যে, পালাতে গিয়ে কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে গেল। দিবি বাবা একটু টিউবওয়েলটা পাম্প করে? এখানেই একটু ধুয়ে টুয়ে নিই। গায়ে গায়ে শুকিয়ে যাবে। কাপড় পালটাতে হলে আবার মাইলটাক হেঁটে যাওয়া। যা খাড়া রোদ।
আসুন জ্যাঠামশাই, পাম্প করে দিচ্ছি।
রাস্তার কলে ধুতিটা ধুতে ধুতে ধীরেন কাষ্ঠ বলছিল, আজকাল আর কেউ ডাকখোঁজ করেও না তেমন। গৌরহরিদার পরিবার তবু তো ডেকেছে।
সাপটা এ যাত্রায় বেঁচে গেল। বিশাল গরাসটা কণ্ঠায় আটকে আছে তার। ধীরে সে একটা পরিত্যক্ত জমি আর ভাঙা বাড়ি পার হল। তারপর বেগুনক্ষেত। বাঁশের বেড়া। আগাছার জঙ্গল। ধীরে ধীরে পিছল গতিতে পার হয়ে যাচ্ছে সে। তার শীতল রক্তে শীতের পদধ্বনি। আর সময় নেই।
.
ঝিরঝিরে চঞ্চল নিমের ছায়ায় বসে একমনে সর্ষে গুঁড়ো করছে সন্ধ্যা। মস্ত এলো খোঁপা ভেঙে পড়েছে পিঠে। দামাল বাতাসের দিন আজ। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস এসে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো পাতা আর উড়ছে তার চুল।
উদুখলের ডান্ডাটা রেখে যখন খোঁপা ফের বেঁধে নিচ্ছিল সন্ধ্যা তখন সাপটাকে দেখতে পেল। ঘন জঙ্গল থেকে উঠে উঠোনের কানা দিয়ে দীর্ঘ শরীরটা খুব আস্তে টেনে নিয়ে খড়ের মাচানের নীচে তার অন্ধকার জগতে ঢুকে যাচ্ছে। গলার কাছটায় একটা ঢিবি। ব্যাঙ বা ইঁদুর গিলে এসেছে এইমাত্র।
মাই গড! ইটস এ বিগ কোবরা!
সন্ধ্যা মুখ তুলে বুডঢাকে দেখল।
বুডঢা বলল, দেখতে পাওনি? জাস্ট বিলো দি হে স্ট্যাক।
দেখব না কেন? চোখের সামনে দিয়েই তো গেল।
লাঠি-ফাঠি কিছু নেই বাড়িতে?
থাকবে না কেন? লাঠি দিয়ে কী করবে?
বাঃ, মারতে হবে না সাপটাকে?
ওটা বাস্তুসাপ মারতে নেই।
হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বাস্তুসাপ? এ স্নেক ইজ এ স্নেক। ইট মে বাইট এনিবডি এনিটাইম।