- বইয়ের নামঃ চক্র
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-৫. ঘুমের সময়
০১.
ওই এল তার ঘুমের সময়। বাতাসে শীতের শিস, তার দীর্ঘ শরীরে ঘুমের রিমঝিম। আর সময় নেই। শরীরে ভরে নিতে হবে যথাসাধ্য রসদ। তারপর মাটির নীচে কবোষ্ণ অন্ধকারে ঢুকে পড়বে সে। ঘুম আর ঘুম। নেমে আসবে ঘুমের ভারী পর্দা। তার মন নেই, বিবেক নেই, সে কে বা কেমন তাও জানা নেই। তার আছে কেবল শরীর। আছে সন্ধানী চোখ, বিদ্যুতের মতো গতি, আর ক্ষুধা, আর ভয়।
নবীন ভটচাযের লাকড়িঘরের পিছনে শ্যাওলা ধরা একটা ইটের খাঁজে ব্যাঙটাকে পেয়ে গেল সে। বিশাল হলদেটে ব্যাঙ। তাকে দেখে ব্যাঙটা প্রাণভয়ে একটা লাফও দিয়েছিল। দ্বিতীয় লাফটা দেওয়ার মুখে প্রায় শূন্য থেকে তাকে সে লুফে নিল মুখে। খাদ্যগ্রহণ তার কাছে সুখপ্রদ নয়। তার জিহ্বা আস্বাদহীন। কম্পিউটারে ভরে দেওয়া তথ্যের মতোই সে শুধু জানে কোনটা খাদ্য, আর কোনটা নয়। আর খাদ্যগ্রহণও কি কম কষ্টের? ধীরে, অতি ধীরে বিশাল গরাসটাকে গিলতে হয় তার। চোয়াল ছিঁড়ে যেতে চায়, গলা আটকে আসে, বঁড়শির মতো দাঁতে আটকানো ব্যাঙটা বারবার ঝটকা মারে আর কাঁপে আর কঁ-অঁ-ক, কঁ-অঁ-ক করে প্রাণভয়ে অন্তিম আর্তনাদ করতে থাকে। আস্তে আস্তে তিল তিল করে তাকে আত্মসাৎ করতে হয় জীয়ন্ত গরাস। বড় কষ্ট তার। ঘুমিয়ে পড়ার আগে খেয়ে নিতে হবে আরও খাবার। আরও কষ্ট, আরও অধ্যবসায়।
অনেকক্ষণ সময় লাগল তার। আতাগাছের চিকড়ি-মিকড়ি ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে রোদের বল্লম এসে বেঁধে তার চোখে। বাতাসে শীতের নির্ভুল সংকেত, হাওয়া ঘুরছে, ঘুরে যাচ্ছে উত্তরে। সূর্য হেলে যাচ্ছে দক্ষিণে। তার শরীরে সব খবর পৌঁছে যায়।
শত্রুর অভাব নেই তার। ছোট্ট বিচরণভূমি ভরে আছে প্রতিপক্ষে। তাই ঘাসে, ঝোপে, মাটির খাঁজে, গর্তে কেবলই আত্মগোপন করে থাকা। অন্তরালই একমাত্র বাঁচিয়ে রাখে তাকে।
গলার কাছ বরাবর শ্বাসরুদ্ধ করে আটকে আছে ব্যাঙটা। প্রবল পরিশ্রমে শরীর নিথর। মাটিতে সামান্য কম্পন, চোখে একটা ছায়া পড়ল, একটু নড়াচড়া। সে জানে এখন সে বড় অসহায়। অবসন্ন শরীরে সেই বিদ্যুতের গতি নেই, আক্রমণও নেই। সে ভয় পাচ্ছে। সে একবার প্রতিপক্ষকে দেখে নিল। তারপর শরীরের ভার টানতে শুরু করল। প্রতি মুহূর্তেই তাকে আত্মগোপন করতে হয়।
তার দীর্ঘশ্বাসে বাতাস কেঁপে উঠল। পিঙ্গল শরীরটাকে বইয়ে দিল সে। কিন্তু বড় কষ্ট। শরীর জুড়ে যেন ব্যথার মৃদঙ্গ বেজে যাচ্ছে।
.
পেচ্ছাপের বেগটা ছেড়ে দিয়েই ধীরেন কাষ্ঠ বুঝতে পারল কাজটা ঠিক হয়নি। উঁচু ঢিবিমতো জায়গা দেখে বসে পড়েছিল, চারদিকটা খেয়াল করেনি। ব্যাঙটার প্রাণঘাতী আর্তনাদ শুনে তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। দু চোখেই ছানি বলে নজর ঘষাকাচের মতো। সামনে শুকনো পাতার ডাঁই, গাছের ছায়া। প্রথমে নজরে পড়ল না। ঠাহর করে দেখতে পেল, হাত দেড়েক দূরে পাকা গোখরোটা ব্যাঙটাকে ধরেছে আর তার পেচ্ছাপের ধারাটি ছড়ছড় শব্দ তুলে তেড়েফুড়ে ওই দিকেই যাচ্ছে। অতি বিপজ্জনক পরিস্থিতি। চমকে গেলে পেচ্ছাপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ধীরেন কাষ্ঠর কপালটাই খারাপ। বয়সকালে এখন পেচ্ছাপ পেলে বেগ চেপে রাখতে পারে না। শরীরের যন্ত্রপাতি ক্রমেই কেলিয়ে পড়ছে। পেচ্ছাপ তার নিজের মনেই হয়ে যাচ্ছে, ধীরেনের সাধ্যই নেই এখন বন্ধ করে। তা হলে কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে যাবে। পারবে না জেনেও একটা চেষ্টা করল ধীরেন, মুখ ফসকে একটা কোঁতানির শব্দও বেরোল। কিন্তু আটকানো গেল না। খাওয়ার সময় সাপটা বিরক্ত হচ্ছে। যদি রেগেমেগে তেড়ে আসে তাহলেই হয়ে গেল। না, কাজটা ঠিক হচ্ছে না, ঠিক হচ্ছে না। আজকাল তার এইসব ছোটখাটো কাজে বড় মাপের সময় লাগে। বয়সকালে লাগত না। অসহায় ধীরেন কাষ্ঠ তাই তার বিশ্বাঘাতক পেচ্ছাপের ধারাটাকে নজরে রাখছিল। হ্যাঁ, ওই আঁকাবাঁকা হয়ে ব্যাটা ঠিক গিয়ে সাপটার পেটের তলায় ঢুকে পড়ল। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল ধীরেন। শরীরটা শক্ত হয়ে এল আতঙ্কে। ভরসার কথা এই, মুখে ব্যাঙটা ধরে থাকায় চট করে ছোবল দিতে পারবে না। তবে সাপকে বিশ্বাসই বা কী?
ঠিক এই সময়ে সাপটা ফসস করে একটা বিচ্ছিরি শব্দ করায় ধীরেন বা প রে বলে চেঁচিয়ে উঠে পড়ল। পেচ্ছাপ তখনও হয়ে যাচ্ছে।
ধীরেনের চাপা চিৎকার শুনতে পেল পান্না। ডান হাতের দুটো আঙুল–মধ্যমা আর তর্জনী চোখের সামনে তুলে ধরে সে তখন লটারি করছে–গলায় দড়ি না গায়ে আগুন? গায়ে আগুন না গলায় দড়ি? কদিন হল তার এই চলছে। মনটাকে স্থির করতে পারছে না। তবে করবে সে ঠিকই। কিন্তু কোনটা বাছবে তা ঠিক করতে দেয়ালঘড়ির দোলকটার মতো দোল খাচ্ছে। কখনও মনে হয় গায়ে আগুন, কখনও মনে হয় গলায় দড়ি। উনিশের ভরা যুবতী সে, এই বয়সেই তো মরতে সাধ হয় সবচেয়ে বেশি। মনে একটু টুসকি লাগলেই মনে হয়, মরি। আকাশে রাঙা চাঁদ উঠলে কি একটু ভালবাসা না পেলে, কি শীতের দুপুরে মন হু হু করলেই হল, মরণ মুচকি হেসে শ্যামের বাঁশি বাজাতে থাকে।
সে মরলে কী কী হবে ভাবতেই আনন্দে গায়ে কাঁটা দেয় তার। লুটোপুটি খেয়ে কাঁদবে মা, ও পান্না, ফিরে আয়। বেশ হবে। যত অবিচার করেছে মা তা শোধ হবে চোখের জলে। আর কখনও বলবে না, গতরখাকী মর না। আর বাবা? বাবা এমন স্তম্ভিত হয়ে যাবে যে কাঁদতেও পারবে না। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকবে দাওয়ায় আর অবিশ্বাসভরে মাথা নাড়বে, এ হয় না, এ হয় না। আর হীরা, হীরার কথা কিছু বলা যায় না। হিংসুটিটা কে জানে বাবা খুশিও হতে পারে। আবার হয়তো দিদির শোকে লুটোপুটি খেয়ে কাঁদতেও পারে। মনে হয় কাঁদবেই। কাঁদলে খুব কাঁদবে। আর সে? সে কী করবে তা জানে না পান্না। তবে খুব বিষণ্ণ আর আনমনা হয়ে যাবে। হু-হু করবে বুক, চোখ ভিজে যাবে বারবার। এ কী করলে পান্না, আমাকে একা রেখে গেলে নির্বান্ধব পৃথিবীতে? এই সেটা যে কে তা আজও জানে না পান্না। সে-র সঙ্গে তার চেনাই হয়নি। সে যে কেমন তাও ঠিক করে ভাবেনি সে। আবছা আবছা একটা মুখ কল্পনা করে নেয়। আবার মুখটা কেমন বদলেও যায়।