ধরো তো দেখি! শ্যাম হাসে। ইতুর দিকে খেলার ছলে একখানা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ছোঁও তো দেখি!
কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে থেকে হঠাৎ মৃদু হাসে ইতু। বলে, তুমি খেলতে চাও?
শ্যাম মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
ঠিক আছে। ইতু পলকের মধ্যে তার শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে নেয়, ছুঁতে পারলে আমার জিত!
জিত!
শ্যাম দরজা বন্ধ করে দেয়।
মুখোমুখি দু’জন একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ইতুর শরীর ভারী হয়ে গেছে অনেক। কোমরে আঁচল জড়ানোর পর এখন দেখা যাচ্ছে তার তলপেটে চর্বির একটু ঢিবি। হাতে গলায় মাংসের খাঁজ। তবুশ্যাম জানে, ইতু নাচ শিখত। তাই সে সতর্ক হয়।
ইতু সোজা এগোয় না, হালকা পায়ে দেয়ালের দিকে সরে গিয়ে ঘুরে আসতে থাকে। হাসে। শ্যাম চটুল পায়ে উলটো দিকে ঘুরে যায়, বলে, বা আপ, ইতু।
ইতু হাসে। ঘুরতে থাকে। শ্যাম ঘুরতে থাকে। ঘরের সবকিছুই শ্যামের চেনা। দরজার দিকে গেলে তার ডান ধারে চৌকি, মাঝখানে চেয়ার, বাঁ ধারে স্টোভ জ্বলছে। জানালার দিকে গেলে ঠিক উলটো। এক ধারে তূপ হয়ে থাকা বই। একটা মোটা বই মেঝের ভিতরে এগিয়ে আছে। শ্যাম বইটা পেরিয়ে যায়, চৌকির পাশ দিয়ে মন্থর গতিতে সরে যায়, চেয়ারটায় একবার হাত রাখে। ডান ধারে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ থেমে বিদ্যুৎগতিতে সোজা এগিয়ে আসে। সাপের ছোবলের মতো তার হাত ছুটে আসে শ্যামের বুকের দিকে। অল্পের জন্য এড়িয়ে যায় শ্যাম, লাফিয়ে উঠে যায় চৌকিতে, দরজার দিকে লাফ দিয়ে নামে। হাসে। বাঁ দিকে ঘুরতে থাকে। ইতু হাসে। বাঁ দিকে ঘুরতে থাকে।
ইতু দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ, এই, কী হচ্ছে ছেলেমানুষি!
শ্যাম দাঁড়ায়, দূর থেকে বলে, ছুঁতে পারলে তোমার জিত।
আমি জিত চাই না। তুমি কাছে এসো।
খেলার নিয়ম ভেঙো না ইতু। শ্যাম বলে, খেলে জেতো।
ইতু বিছানায় বসে পা নাচায়, আচ্ছা, ছুঁতে চাই না তোমাকে।
শ্যাম দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইতু ঠোঁট টিপে হাসে, অন্য দিকে চোখ রাখে, তারপর হঠাৎ লাফিয়ে উঠে এগিয়ে আসে। শ্যাম চমকে সরে যেতে গিয়ে কষ্টে স্টোভটার ওপর পড়ে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচায়। জানালার চৌকাঠে ভর দিয়ে সরে যায়, বলে, আঃ ইতু, তোমার বুদ্ধি বেড়ে গেছে। তোমার উন্নতির আর দেরি নেই।
সিগারেটটা পড়ে গিয়েছিল মুখ থেকে, ইতু সেই জ্বলন্ত সিগারেট তুলে নিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারে। বিছানায় পড়লে শ্যাম সেটাকে তুলে নিয়ে বলে, থ্যাঙ্ক ইউ।
ইতু বেপরোয়াভাবে চেয়াবটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, কপালের ওপর থেকে কুঁচো চুল সরায়, সোজা এগিয়ে আসে। শ্যাম নিচু হয়ে তার পাশ দিয়ে, খুব কাছে দিয়ে উলটো দিকে চলে যায়, বলে, ঠান্ডা মাথায় খেলো, রেগে গেলে শুধু ঘুরে মরতে হবে।
ইতু সে-কথা শোনে না। সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে এগিয়ে আসবার চেষ্টা করে। অন্ধের মতো সে পর পর চেয়ার চৌকি এবং দেয়ালে ধাক্কা খায়, মেঝের মোটা বইটাতে হোঁচট খেয়ে সামলে যায়। রাগে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চাপে। তার মুখ লাল হয়ে আসে, মুখে ঘাম চিকমিক করে ওঠে।
অল্প একটু উত্তেজনা বোধ করে শ্যাম। খেলা তাকে পেয়ে বসে। হালকা গলায় সে বলে, খেলো ইতু, খেলো। তোমাকে এখন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।
বিছানার কাছে ইতু একটু থেমে যায়। হাত-ব্যাগটা তুলে নিয়ে ছুড়ে মারে শ্যামের দিকে। শ্যাম মাথা নিচু করলে সেটা দেয়ালে লাগে, তারপর সোজা নেমে এসে স্টোভের ওপর থেকে কেটলিটা উলটে দেয়। দপ করে স্টোভের আগুন ওপরে ওঠে, কেটলির জল মেঝে ভাসিয়ে দিতে থাকে। শ্যাম তার চেনা ঘরের নিরাপদ কোণে সরে যায়।
ইতু একটানে চেয়ারটাকে সরিয়ে দেয়, মেঝের গরম জল লাফ দিয়ে পার হতে যায়। পুরো টাল সামলাতে পারে না। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে হাঁফায়, বলে, শ্যাম, আমাকে আর কষ্ট দিয়ো না।
ইতুকে হঠাৎ খুব বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। কোমরের আঁচল খুলে স্টোভের ওপর ঝুলছে।
শ্যাম বলে, থেমো না ইতু, খেলো৷ খেলে যাও। তারপর হাত বাড়িয়ে বলে, এই তো আমি। ছোঁও!
শ্যাম হাসে, দূরে সরে যায়, লাফ দিয়ে ওঠে চৌকির ওপর, এসো ইতু, খেলো,নইলে এক্ষুনি আবার আমি ঝিমিয়ে পড়ব।
ইতু তবু দাঁড়িয়ে থাকে, বলে, আমি আর পারছি না, শ্যাম।
পারবে। শ্যাম হাসে, ঠান্ডা হয়ে বসে থেকে কী লাভ! খেলো।
ইতু শ্লথ পায়ে এগোয়। শ্যাম সরে সরে যায়। তারপর চেয়ারটার চার দিকে তারা ঘুরপাক খায়। বড় বড় শ্বসের শব্দে ভরে ওঠে ঘর। তবু শ্যাম হাসে, ইতুকে থামতে দেয় না। ইতু প্রাণপণে চেষ্টা করে। শ্যাম ঘুরে ঘুরে চৌকির ওপর ওঠে, জানালার ধারে চলে যায়, দেয়ালের দিকে সরে আসে, গরম জলের স্রোত লাফিয়ে পার হয়। লক্ষ করে, ইতু দু’হাত বাড়িয়ে অন্ধের মতো ঘুরছে, শ্যাম যেদিকে তার উলটো দিকে যাচ্ছে। শ্যাম শিস দিয়ে জানিয়ে দেয় সে কোন দিকে আছে।
শ্যাম হাসে, শ্বাসের সঙ্গে বিড়বিড় করে বলে, খেলো ইতু, খেলো। তোমাকে একটু ভাল লাগতে দাও। আমার শরীর গরম হচ্ছে না ইতু, বহুকাল ধরে আমি ঠান্ডা হয়ে আছি। খেলো ইতু, খেলে আমাকে ছোঁও। তারপর তোমার জিত।… আঃ ইতু, তুমি মোটা হয়ে গেছ একটু, পেটে চর্বি জমছে, বয়সও হয়ে এল। সময় থাকতে থাকতে খেলে নাও… বুড়ো হয়ে যাওয়ার আগে খেলে নাও… মরে যাওয়ার আগে খেলে নাও…সবকিছু সহজে পেতে নেই, পাওয়া উচিত নয়… এতকাল তোমাকে বড় সহজেই পেয়ে যেতুম, তাই তুমি আমাকে সবচেয়ে কম লাভবান করেছ।… আঃ হাঃ ইতু, ওদিকে নয়, আমি জানালার কাছে সরে এসেছি… আঃ ইতু, পড়ে যেয়ো না, খেলা মাটি হবে…অত সহজে হাল ছেড়ে দিয়ো না… থেমো না… থামলেই তুমি দুয়ো…থামলেই তুমি বুড়ো… থামলেই তুমি মাটির ঢেলা…ঘোরো, ঘুরতে থাকো… ঘুরতে ঘুরতে ছায়া হয়ে যাও ইতু,… মায়াবিনী হয়ে যাও… রহস্যময়ি হয়ে যাও… দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাও… আমি যেন ভিখিরির মতো তোমাকে কামনা করি… আমি যেন হাঁটু গেড়ে বসি তোমার জন্য… আমি যেন তোমার জন্য পাগল হতে পারি… আঃ হাঃ ইতু, তুমি স্টোভের বড় কাছে গেছ… ধীর হয়ে গেছে তোমার পা… আবার তোমার আঁচল খুলে দুলছে আগুনের ওপর… ওঃ ইতু!