মিনু কাউকে কোনও জবাবদিহি করল না, নীরবে শেষবার শ্যামকে দেখে নিয়ে ভিড় ঠেলে গটগট করে বেরিয়ে গেল।
আবার আস্তে আস্তে মিনুর হাত থেকে ছাড়া-পাওয়া তার শরীর মাটির দিকে নেমে যাচ্ছিল। কেন মিনু তাকে মারল তা বুঝল না শ্যাম। বুঝবার দরকারও ছিল না। শরীর ভরে আসছে জ্বর, সে কোনও ব্যথা-বেদনা টের পায় না, তার কেবল ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। চেয়ে দেখে, অচেনা অলীক ছায়ার মতো মানুষেরা তাকে ঘিরে জড়ো হচ্ছে। সে বিড় বিড় করে বলে, সরে যাও, ওই কাচের দরজাটা আড়াল কোরো না।
আশ্চর্য! ভিড় ভেদ করে সে কাচের দরজাটা দেখতে পায়। ছায়ার মতো লীলা এসে কাচের গায়ে মুখ রেখে দাঁড়িয়েছে। স্পষ্ট বুঝতে পারে শ্যাম, লীলা আজ তার অপেক্ষায় ছিল। শ্যামের প্রিয় ছিল বাসন্তী রং। সেই রঙেরই শাড়ি পরেছে লীলা, শান্ত বিষণ্ণ তার চোখ, সমস্ত শরীরে মা হওয়ার আগের নতা ফুটে আছে। চাপা কান্নায় লীলার ঠোঁট কাঁপছে কেন, এত নিষ্ঠুর কেন তোমরা! ও লোকটা আমার কোনও ক্ষতি করেনি কোনও দিন…
হঠাৎ আবার শ্যামের বুকের মধ্যে গুর গুর করে মেঘ ডেকে ওঠে, চমকে ছুটতে থাকে হরিণের পাল…তারপর কেবল হরিণ আর হরিণ, সরল ও সুন্দর চোখের হরিণেরা ছুটে আসে দিগ্বিদিক জুড়ে…মেঘের দুপুরে অচেনা এক রেল পুল পার হতে থাকে কালো রেলগাড়ি…বৃষ্টির জলে ভরে ওঠে বুক…
অস্বচ্ছ চোখে ভিড়ের মধ্যে এক-আধটা চেনা মুখ খুঁজে বেড়ায় শ্যাম—আঃ সোনাকাকা! রাঙ্গাপিসি। মানুমামা! আমি মনু, আমি তোমাদের মনু…জন্ম নেওয়া বড় কষ্টকর, তবু তোমাদের জন্যই এই দেখো আমি আর-একবার জন্ম নিচ্ছি…ভালবাসা যে কত কষ্টের তা জানে তামার মা, তবু আমি সেই কষ্ট বুকে করে নিলুম…শিগগিরই আমি সুসময় নিয়ে আসছি পৃথিবীতে…অপেক্ষা করো…
বড় মায়ায়, বড় ভালবাসায় ধুলোমাটির মধ্যে মুখ গুঁজে দেয় শ্যাম।