অনেক দিন হয় আর আয়না দেখেনি শ্যাম। তাকের ওপর থেকে আয়নাটা তুলে নিতে গিয়ে দেখল অনেক ধুলো জমে আছে। নিজের আবছা অলীক এক মুখচ্ছবির দিকে সে একটু তাকিয়ে রইল। বলল, আমি নই। তারপর মাথা নেড়ে নিজের প্রতিচ্ছবিকে বলল, তুমি! তুমি করেছিলে! তারপর হাসল শ্যাম।
না। তোমাকে চিনি না। শ্যাম বলল।
ময়লা এন্ডির চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিল শ্যাম। সাবধানে তালা দিল ঘরে। ধীর পায়ে বেরিয়ে এল।
এসে বসল সেই ছোট্ট নির্জন চায়ের দোকানটায়। এক কাপ চা নিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল চুপচাপ, সিগারেট ধরাল। তারপর হঠাৎ খেয়াল হতে সে বাচ্চা বয়টাকে ডেকে আর-এক কাপ চা দিতে বলল। চা দিয়ে গেলে সে চায়ের কাপটা উলটো দিকের শূন্য চেয়ারের সামনে টেবিলের ওপর রাখে, ছাইদানিটা বসায় চায়ের কাপটার পাশে, একটা সিগারেট ধরিয়ে যত্নে রাখে ছাইদানিটার ওপর। বাচ্চা বয়টা চোখ গোল করে এই দৃশ্য দেখে, দোকানের বুড়ো মালিক তাকে লক্ষ করে, দুটি ছোকরা খদ্দের কথা থামিয়ে চেয়ে থাকে। শ্যাম লক্ষও করে না তাদের। শূন্য চেয়ারটার সামনে টেবিলের ওপর নিঃশব্দে পুড়তে থাকে একটি আস্ত সিগারেট, ধোঁয়া উঠে উঠে ঠান্ডা হয়ে আসে এক কাপ চা। মনে মনে নত হয়ে কথা বলে শ্যাম, গৌর ভৌমিক, যদি পারো তবে আবার জন্ম নিয়ো। আমি জানি, আবার জন্ম নেওয়া বড় সহজ হবে না। শূন্য থেকে, জল থেকে, বাতাস থেকে, মাটি থেকে আবার নিজের শরীর সংগ্রহ করে আনা, এবং তারপরও আবার ভুল, কেবল ভুল জীবন যাপন করে যাওয়া…তবু বড় ইচ্ছে হয়। আর-একবার, আরও একবার পৃথিবীতে জন্ম নিতে…গৌর ভৌমিক হয় না! যদি পারো আরও-একবার জন্ম নিয়ো, ততদিনে আমি পৃথিবীকে সুন্দর করে দেব, তুমি নিরাপদে পেরিয়ে যাবে, রাস্তার প্রতিটি বাঁক ঝড়ের বেগে পার হবে…লীলার কোলে শিশু হয়ে এসসা, আমি যত্নে তোমাকে বড় করে তুলব…
তারপর সে ওঠে। দুকাপ চায়ের দাম দিয়ে দেয়। বেরিয়ে পড়ে। তুমি ছেলে ছিলে, তুমি স্বামী ছিলে, তুমি ছিলে বাবা। তুমি এত কিছু ছিলে কেউ জানতই না। আবার দেখো, তুমিই উড়ন্ত মোটরসাইকেলে ছুটে যাওয়া এক বিচ্ছিন্ন মানুষ। তুমি পৃথিবীর কেউ না।…গৌর ভৌমিক, আমার ওপরওয়ালা বাস্টার্ড বলে গাল না দিলে আমি কি চাকরি ছাড়তুম? চাকরি না ছাড়লে আমি খেলার ছলে তোমার মুখে ফেলতুম আয়নার আলো? দেখো, এ-সবকিছুই একটি রহস্যময় কার্যকারণসূত্রে বাঁধা। তুমি কাকে দায়ি করবে? এই দুহাত শূন্যে তুলে ধরে বলছি আমি দায়ি নই। আবার দেখো মাথা নিচু করে আমিই স্বীকার করছি, আমি দায়ি। তুমি কাকে দায়ি করবে? মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের ঘোরে আমি ডাক দিয়ে উঠি, শ্যাম! আবার নিজেই উত্তর দিই, যাই। নিজের সঙ্গে সব বোঝাপড়া আমার শেষ হয়নি। এখনও আমার ভিতরে রয়েছে একজন অচেনা শ্যাম।…না, পৃথিবী এখনও তেমন সুন্দর নয়, তবু আমি অপেক্ষায়
আছি…জন্ম নাও, আর-একবার জন্ম নাও, আমাদের কাছে এসো…
অনেকক্ষণ ধরে ধীরে হেঁটে হেঁটে বিচিত্র সব রাস্তার ভিতর দিয়ে চলে গেল শ্যাম। কখনও মাথার ভিতরে, কখনও বুকের ভিতরে ভ্রমরের গুনগুন শব্দের মধ্যে গভীর থেকে গভীরে চলে গেল একটি মোটর-সাইকেলের শব্দ। মাঝে মাঝে চমকে উঠল শ্যাম। নিজেকে ডেকে বলল, তুমিও…তুমিও উড়ন্ত মোটর-সাইকেলে ছুটে যাওয়া এক বিচ্ছিন্ন মানুষ। তুমি পৃথিবীর কেউ না…
না, তা নয়। শ্যাম জানে। সে শ্যাম চক্রবর্তী, বাবা কমলাক্ষ চক্রবর্তী, বিক্রমপুরের বানিখাড়া গ্রামে তার দেশ, সে ছিল সেইন্ট অ্যান্ড মিলারের ছোটসাহেব। এ-সব কিছুর মধ্যে সে বাঁধা আছে। অথচ সে জানে না সে কে! কিংবা সে কীরকম!
১৪. তালু শুকনো
তালু শুকনো। অল্প একটু মাথা ধরা আর সামান্য পিপাসা টের পাচ্ছিল শ্যাম। তার জ্বর আসছে। দুপুরে স্নান করার সময় তার গা শিরশির করছিল। তবু তার মনে হয়েছিল যে যথেষ্ট ঠান্ডা হচ্ছে না তার গা। শরীরেও অনেক ময়লা জমে আছে। তোয়ালে ঘষে সারা শরীরের ময়লা তোলার চেষ্টা করেছিল সে, তারপর অনেক জল ঢেলেছিল। তেল-না-দেওয়া রুক্ষ শরীর শীতে ফেটে-ফুটে গেছে, সেইসব ফাটা জায়গায় ঠান্ডা জল ঢুকে রি-রি করে কাঁপছিল সে। কান কনকন করে উঠল, ঠান্ডায় মাথা ধরে গেল, দাঁত ব্যথা করে উঠল। তবুও সে অনেক, অনেকক্ষণ ধরে স্নান করেছিল আজ। তারপর ময়লা এন্ডির চাদরটা গায়ে দিয়ে যখন সে হোটেলে বেরোচ্ছিল তখন থিরথির করে তার শরীর কাঁপছে, চোখে জ্বালাজ্বালা ভাব এবং মনে সন্দেহ যে শরীর যথেষ্ট পরিষ্কার হয়নি। এখনও ময়লা রয়ে গেছে। আরও অনেকবার অনেকক্ষণ ধরে তার স্নান করা দরকার।
ভাতের প্রথম গ্রাস মুখে তুলেই সে টের পেল ঘূর্ণি ঝড়ের মতো শবীবের ভিতর থেকে বমি উলটে আসছে। টেবিলে ভর রেখে চিনেমাটির প্লেটের ওপর সে মুখ নিচু করে রইল অনেকক্ষণ। তার মুখ থেকে বেয়ে লালা নেমে যাচ্ছিল প্লেটের ওপর। কেউ দেখে ফেলার আগেই সে রুমালে ঢেকে নিল মুখ। তারপর মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল। অস্পষ্ট গলায় আধঘুমন্ত ম্যানেজারকে বলল, খাবারটা কুকুরকে দিয়ে দেবেন।
কী হল?
শরীর ভাল নেই।
বেরিয়ে এসে পানের দোকান থেকে নুন, মশলা আর লেবুর রস দেওয়া একটা সোডা খেল সে, আর দুটো মাথা ধরার বড়ি। জিভে কোনও স্বাদ নেই। তার জ্বর আসছে। হয়তো খুব অসুখ হবে তার। অনেক দিন সে তাৰ শবীরের যত্ন নেয়নি, অনেক দিন ভাল করে লক্ষ করেনি নিজেকে। তাকে অন্যমনস্ক রেখে অনেক দিন ধরে তার শরীর অসুখ তৈরি করেছে। কে জানে, হয়তো এবার বহুকাল তাকে শুয়ে থাকতে হবে ঘরে কিংবা হাসপাতালে।