শ্যাম মাথা নাড়ে। হ্যাঁ।
অরুণ বলে, তোকে দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। বলে অস্বস্তির হাসি হাসল, অনেক দিন তোর খোঁজখবর রাখিনি, জানি না সত্যিই এখন কী করছিস। সেদিন তোর সঙ্গে দেখা হলে অনেক কথা বলে দিয়েছিলাম। আজ তাই হঠাৎ তোকে দেখে কেমন যেন মনে হল তুই-ই আমার শ্বশুরের সেই লোক। বলে হাসে অরুণ, তোকে পাকা মস্তানের মতো দেখাচ্ছিল।
উত্তর দেয় না শ্যাম। স্থির দাঁড়িয়ে অরুণকে দেখে।
আস্তে আস্তে অরুণের মুখ থেকে হাসি সরে যায়। ভিখিরির মতো গলায় সে বলে, আমি তোর জন্য সব করব শ্যাম। আমি অনেক কিছু পারি। আমি শালা পালাতে চাই। একবার যেতে পারলে আমি আর ফিরব না।…ওই কুচ্ছিত বউ, ওই হারামি বুড়ো আর এই ভিখিরির দেশ ছেড়ে পালাতে পারলে শালা…আবার আমি বড়লোক হয়ে যাব। বলে অসহায়ভাবে চারদিকে তাকায় অরুণ, জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে, আমার এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। এখনও আমার বয়স আছে…কিন্তু সব গোলমাল হয়ে যাবে শ্যাম, যদি তুই একবার ফোন তুলে বুড়োকে বলে দিস যে, আমি আজ লীলার সঙ্গে ছিলুম বিকেলে…
হঠাৎ আবার শ্যামের বুকের মধ্যে গুর গুর করে মেঘ ডেকে ওঠে, চমকে ওঠে বিদ্যুৎ। হরিণ দৌড়োয়। আর কালো একটা রেলগাড়ি লম্বা একটা রেল পুল পেরিয়ে যেতে থাকে।
ধীর শান্ত গলায় সে প্রশ্ন করে, তুই লীলাকে কখনও ছুঁয়েছিস?
আঁ! বলে অরুণ অর্থহীন চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর দুঃখে মাথা নাড়ে, না। তারপর বদমাশের মতো হাসে, সি ইজ ইন লাভ। ততার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব বলেছিলুম, না? করবি আলাপ?
শ্যাম আবার বলে, আজ বিকেলে কী কী হয়েছিল?
নাথিং। হাসে অরুণ, আমরা ভাইবোনের মতো ছিলুম। বলে বড় করে শ্বাস ছাড়ে অরুণ, আজই প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। বললুম, ভিড় ছেড়ে একটু নির্জনে চলল। বলল, না। বললুম, একটু ট্যাক্সিতে ঘুরে বেড়াই চলল। বলল, না। জিজ্ঞেস করলুম, রাত্রে একা একা লাগে না? ভীষণ রেগে গেল—বলতে বলতে অরুণ হেঁচকি তুলে হেসে উঠল, আসলে মেয়েটা একেবারে বাচ্চা, আর নতুন। তার ওপর বোধ হয় এনগেজড। তবু আমি অম্বিকা হালদারের জামাই, আমাকে এড়াতে পারে না বলে এসেছিল বলতে বলতে সামান্য অহঙ্কারী হয়ে গেল অরুণের মুখ-চোখ! হেসে বলল, দূর শালা, এর চেয়ে মিস দত্ত অনেক হট ছিল। কী বাটক মাইরি…
আস্তে আস্তে উঠে মেঝেতে নিজের বমির ওপর দাঁড়াল অরুণ। বলল, শ্যাম, আমার দিব্যি মাইরি, বুড়ো যদি জানতে পারে…তোর শালা চোখ বটে! কী করে খুঁজে খুঁজে ওই রেস্তরাঁয় বের করলি আমাকে? নাকি শালা তুই সারাদিন আমার পিছনে লেগেছিলি! অ্যাঁ?
শ্যাম চুপচাপ চেয়ে থাকে। না, তাকে আর কিছুই করতে হবে না। সে বুঝে যায় অরুণকে কষ্ট দেওয়ার ভার অরুণই নিয়েছে।
অরুণ তার বমির ওপর একবার পা হড়কায়, সামলে নিয়ে আস্তে আস্তে দরজার কাছে চলে যায়। হাত তোলে। হেসে বলে,টু অ্যামেরিকা…! চলে যায়। দরজা পর্যন্ত মেঝেতে তার বমিতে ভেজা পায়ের ছাপ পড়ে থাকে।
শ্যাম জানালা দিয়ে দেখে অরুণ রাস্তার ধারে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে একখানা হাত শূন্যে তুলে অদৃশ্য ট্যাক্সি থামানোর চেষ্টা করছে।
সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অরুণ ঠিক পৌঁছে যাবে–শ্যাম জানে। কাল সকালে আজকের কথা মনে থাকবে না অরুণের। প্রতিদিনই ওইভাবে আগের দিনের কথা ভুলে যেতে যেতে ঠিকঠাক মতোই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যাবে অরুণ। ঘরের মেঝের দিকে চেয়ে অর্থহীন হাসল শ্যাম।
অনেক দিন পর তার ইচ্ছে করল ঘরটাকে একটু সাজায়।
১৩. আজকের কাগজে খবরটা আছে
হ্যাঁ। আজকের কাগজে খবরটা আছে। ঠিক বোঝা যায় না, তবু বোধহয় এটাই সেই খবর।
প্রথমে কিছুক্ষণ নিজের চোখ, বোধশক্তি এবং ইন্দ্রিয়গুলিকে বিশ্বাস হয় না শ্যামের। তারপর আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারে ঘটনাটা বোধহয় ঘটে গেছে। সত্যিই। কিছুকাল আগে দক্ষিণ কলকাতায় এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত শ্রীগৌর ভৌমিক (৩২) গতকাল দুপুরবেলা শুকলাল কারনানি হাসপাতালে মারা গেছে। দুর্ঘটনার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার জ্ঞান ছিল না। মৃত্যুর দু’বছর আগে তার বিয়ে হয়েছিল এবং তার একটি শিশুকন্যা আছে। আছে বাবা মা এবং তিন ভাইবোন। লোকটা খুব অখ্যাত ছিল না, রেডিয়োতে গান গাইত এবং তার দুটি রেকর্ডও আছে। যদিও গান শোনেনি শ্যাম, এবং লোকটার নামও তার জানা ছিল না।
এই সেই লোক কি না কে জানে! শ্যাম জানে না। আস্তে আস্তে খবরের কাগজটা সে মাটিতে রেখে দিল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সে একটা সিগারেট ধরায়। আজও সেই রকম রোদ, অবিকল তেইশে ডিসেম্বরের মতো। ওই সেই রাস্তার তে-মাথার বাঁক। লোকটা ডান দিকে মোড় ঘুরতে গিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় আছড়ে পড়েছিল। গেীর ভৌমিক! গান গাইত! একটি শিশু মেয়ে আছে তার। আছে বউ! আছে বাবা মা ভাইবোন! আশ্চর্য, এত সম্পর্কের মধ্যে বাঁধা ছিল লোকটা! অথচ শ্যাম টেরও পায়নি। সে শুধু দেখেছিল একটা মোটরসাইকেলের কালো ভোতা মুখ, আর অচেনা একটা মানুষের ছুটন্ত শরীর। কে জানত যে লোকটার অত পরিচয় আছে!
তবু এই সেই লোক কি না কে জানে! শ্যাম জানে না। যদি এই সেই লোক হয়ে থাকে তবে শ্যাম এ-জন্মের মতো বেঁচে গেল। কোনও দিনই অকারণে আয়নার আলো ফেলার জন্য কেউ তাকে দায়ি করবে না। সমস্ত প্রমাণ লোপ পেল, গোপন রইল কারণ। শুধু জানা গেল যে লোকটা মারা গেছে।