হুইস্কির চেনা গন্ধবহু দূর অতীত থেকে ওই গন্ধ ভেসে আসছে। স্বাদ ভুলে গেছে শ্যাম। ভাবতে ভাবতে সে সিঁড়ি ভাঙে। পিছনে অরুণ।
ঘরে ঢুকে অরুণ হাঁফায়, বিছানায় বসে পড়ে, তারপর বালিশ টেনে নিয়ে আধশোয়া হয়। তার সুটের ভাজ নষ্ট হচ্ছে, সেদিকে তবু খেয়াল করে না অরুণ। বলে, তুই দেখেছিস। তুই সব দেখে বুঝে নিয়েছিস শালা…তোকে আমি…বলতে বলতে আবার দৃষ্টি শূন্য হয়ে যায় অরুণের। হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে।
শ্যাম তার চেয়ার জানালার কাছে টেনে আনে, তার ওপর একখানা পা তুলে দিয়ে দাঁড়ায়। অরুণকে দেখে।
কী বলছিল তা ভুলে গিয়ে অরুণ বলল, ওঃ তোকে আমার শ্বশুরের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, না? তোর হয়ে যাবে শ্যাম, তুই ভাবিস না। আমি বাইরে যাওয়ার আগে তোকে বসিয়ে দিয়ে যাব। বোকার মতো অর্থহীন হাসি হাসে অরুণ, আমি অনেক কিছু পারি, জানিস। আমি শালা অনেক কিছু…ধীরে ধীরে চোখ বোজে অরুণ। বমি করার আগের মুহূর্তের মতো শরীর কেঁপে ওঠে তার, চোখ ঠিকরে ওঠে, মুখ লাল। আবার সামলে যায় অরুণ। হাঁফায়। বলে, তবু কী বলব, ওই বুড়োটাকে আমি ভয় পাই, ওই শালা বুড়ো আমার সবকিছু হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে, ইচ্ছে করলে ও আমায় বাঁদরনাচ নাচাতে পারে, শালা হারামির বাচ্চা…বলতে বলতে আবার বমির ভাব সামলে নেয় অরুণ— আমার পিছনে লোক লাগিয়েছে শালা, শাসিয়েছে দরকার হলে আমাকে গুতা দিয়ে মারবে…
কে! শ্যাম ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে।
আমার বউয়ের বাপ। শালা শ্বশুর…শালা একটা সুন্দর মেয়ের জন্ম দিতে পারেনি মাইরি, তবু শালা শ্বশুর! আমার শ্বশুর!…তুই ভাবতে পারবি না শ্যাম, আমার বউটা কী কুচ্ছিত, ঘর অন্ধকার করে দেওয়ার চেহারা!…তবু আমাকে ইন টাইম ঘরে ফিরতে হবে শালা, না হলে আমি চরিত্রহীন!…আমার বউটাকে যদি তুই দেখতিস শ্যাম। ও যদি অ্যাডালটারি করতে চায় শেয়ালেও ঘেঁবে না ওকে…বলতে বলতে বিছানা থেকে মুখ বের করে মাথা নামায় অরুণ। সমস্ত শরীরে হেঁচকি তোলার মতো কাঁপুনি। শ্যাম লক্ষ করে, ঘোলা জলের স্রোত অরুণের মুখ থেকে কলের জলের মতো ধারায় নেমে এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে তার ঘরের মেঝে। মুহূর্তেই হুইস্কি আর টক বমির গন্ধে ঘর ভরে যায়। বিষিয়ে ওঠে বাতাস। শ্যাম তবু একটুও নড়ে না। পাথরের চাঙড়ের মতো স্থির দাঁড়িয়ে থেকে অরুণকে লক্ষ করে।
ধীরে ধীরে মুখ তোলে অরুণ। কোনও দ্বিধা না করে শ্যামের বালিশ থেকে ময়লা ভোয়ালেটা তুলে নিয়ে মুখ মোছে, আবার সেটা বালিশে পেতে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারপর অধৈর্য ক্লান্ত একটা হাত বাড়িয়ে বলে, সিগারেট!
শ্যাম তার সস্তা সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বিছানায় ছুড়ে দেয়। অনেক কষ্টে সিগারেট ধরায় অরুণ, আগুনের ফুলকি ঠিকরে পড়ে বিছানায়।
আমার শরীরে শালা চিতাবাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তবু শালা আমাকে ইন টাইম ঘরে ফিরতে হবে, তারপর ওই কুচ্ছিত বউটা…মাইরি, একটু লাবণ্য নেই, ডায়েট কন্ট্রোল না করেও এমন হাড়গিলে…ওঃ অ্যামেরিকা…
বালিশে মাথা গুঁজে দেয় অরুণ। কিছুক্ষণ যেন স্বপ্নের ঘোরে একটু হাসে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তোলে আবার। অপরিচিতের চোখে শ্যামের দিকে ঐ কুঁচকে তাকায়, শ্যাম।
তারপর কথা ভুলে গিয়ে আবার হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে।
তুই জানিস না শ্যাম, আমার পিছনে লোক লেগে আছে। কিছুতেই সেই লোককে ধরতে পারছিনা। আমার সব খবর সে দিয়ে দিচ্ছে শালা বুড়োকে। আমি রেস্তরাঁর পর রেস্তরা পালটাচ্ছি, কত গলিঘঁজিতে চলে যাচ্ছি মেয়েছেলে নিয়ে, কত অচেনা জায়গায় যাচ্ছি, কিন্তু কিছুতেই পালাতে পারছি, লুকিয়ে থাকতে পারছি না। বুড়ো আমাকে দাড় করিয়ে আমার সারাদিনের সব গোপন রিপোর্ট আমাকেই শুনিয়ে দিচ্ছে।…মাইরি, তারপর চাকরবাকরের মতো ট্রিট করছে, বাচ্চা ছেলের মতো ধমকাচ্ছে…। কী করে যে খবর পাচ্ছে…
তারপর হঠাৎ হাসে অরুণ, দাঁড়া শালা, একবারই আমি শালা পালাব, ভিসাটা হাতে পাই, তারপর জেটইওর ওয়ে টু অ্যামেরিকা…ভোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ…।
যে-হাতে এরোপ্লেনের ভঙ্গি করে দেখাল অরুণ, সেই হাতটাই হঠাৎ মুঠো পাকিয়ে চাপা গলায় বলল, কিন্তু কে খবর দিচ্ছে। আমি শালা কিছুতেই ধরতে পারছি না, কে!…রাস্তায় হাঁটি, রেস্তরাঁয় বসি, বারে যাই, কিন্তু সবসময়ে আমার ঘাড় সুড় সুড় করে, পিঠের চামড়ায় যেন কার চোখ টের পাই। সবসময়ে ভয়-ভয়, চিন্তা, টেনশন। কে খবর দিচ্ছে। কে!
বাতাসে শূন্য চোখে চেয়ে অরুণ জিজ্ঞেস করে, কে! তারপর আবার ককিয়ে ওঠে, তুই জানিস না শ্যাম, অ্যামেরিকা যাওয়ার মাঝপথ থেকে ওই বুড়ো আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। ইচ্ছে করলে তছনছ করে দিতে পারে আমার ক্যারিয়ার, যখন খুশি ভয় দেখাতে পারে আমাকে…মেয়ের নামে তিনটে বাড়ি দিয়েছে শালা, দুলাখ টাকা। আমি শালা বড়লোক। কিন্তু সব কেড়েকুড়ে নিতে পারে আবার। ইচ্ছে করলে…ইচ্ছে করলে আমাকে হাওয়া করে দিতে পারে…অথচ আমার শরীরে চিতাবাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে, একটা সুন্দর মেয়ের জন্য…একটা সুন্দর কিছুর জন্য…আমি শালা…
আস্তে আস্তে চোখের জল ঝরে পড়ে অরুণের। কোনও শব্দ হয় না, শুধু ঠোঁট দুটো কাপে। শ্যাম স্থির দাঁড়িয়ে দেখে। আস্তে আস্তে শ্যামের দিকে তাকায় অরুণ, ফোঁপানো গলায় বলে, তুই আজ আমাকে দেখেছিস!