ওরা আর কথা বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। লীলার সামনে রাখা খাবারের প্লেট পড়ে থাকে। শ্যাম একটু বিস্মিত হয়— লীলা কি জানে না যে শ্যাম তার খুব কাছেই বসে আছে।
লীলা জানে। একটু পরেই শ্যাম সেটা টের পায়।
বাঁ হাতে জলের গ্লাস ধরে ডান হাতে লীলা তার বেণিটা বুকের ওপর টেনে আনে। ওইভাবে কৌশলে ঘাড় কাত করে অরুণের অজান্তে লীলা হঠাৎ সোজা শ্যামের দিকে তাকায়। যেন লীলা একবারও ঘাড় না ঘুরিয়েই জানত শ্যাম কোথায় বসে আছে। তার চোখের ওপর লীলার চোখ ঝলমল করে ওঠে। আর সেই মুহূর্তে খুব চমকে উঠে শ্যাম দেখতে পায়, লীলা একটু হেসেই হাসিটা ঠোঁটে টিপে দিল, তার চোখ আঙুলের মতো একটু সংকেত করে দেখিয়ে দিল অরুণকে। নিঃশব্দে কয়েক পলকে এইসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। তারপরই স্বাভাবিকভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল লীলা।
আস্তে আস্তে বুঝতে পারে শ্যাম। বুঝতে পারে আজ বিকেলে ইচ্ছে করে কেন একা ধীরে ধীরে এতদুর হেঁটে এল লীলা। লীলা জানত শ্যাম তার পিছু নেবে। তাই এতদূর কৌশলে তাকে টেনে এনেছে লীলা। লীলা ঘাড় না ঘুরিয়েও জানত যে, সে খুব কাছেই বসে আছে। লীলা জানে যে, যে-কোনও আপদে-বিপদে শ্যাম তাকে রক্ষা করবে। তাই সে কৌশলে শ্যামকে বলে দিল—এই লোকটার হাত থেকে আমাকে বাঁচাও।
নিজের ভিতরে শীতল এক নিষ্ঠুরতা অনুভব করে শ্যাম। দুটি মুষ্টিবদ্ধ হাতের মতো শক্ত হয়ে যায় তার চোয়াল। সে অরুণের দিকে চেয়ে থাকে। তার রক্তে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে থাকে। আর একটিমাত্র ইঙ্গিতের জন্য তার সমস্ত শরীর প্রস্তুত থাকে।
মৃদু স্বরে কথা বলে অরুণ। বিরক্তিতে মাথা ঝাকায় লীলা। না। না, না। তারপর কিছুক্ষণ এরকম চলে। শান্তভাবে বসে থাকে শ্যাম। অপেক্ষা করে। তার মাথার ভিতরে ধীরে ধীরে আর সব বোধ লুপ্ত হয়ে যায়, শুধু কুয়াশার মতো জমে ওঠে রাগ।
শ্যাম দেখে, অরুণ বিল মিটিয়ে দিচ্ছে। টেবিলের ওপর থেকে সাদা হাতব্যাগ তুলে নিচ্ছে লীলা। ওরা উঠে দাঁড়াল। ওরা হেঁটে এল, সামনে লীলা। একবার–সেটাও ভুল হতে পারে মাত্র একবার শ্যামের মনে হল, লীলার চোখ তার টেবিলের একটা কোণ ছুঁয়ে গেল।
অরুণ তার দিকে চেয়ে হাসল। সে হাসিতে কোনও ইচ্ছা বা প্রাণ নেই। সেই উঁচু ফিসফিস স্বরে বলল, শ্যাম! একটু দ্বিধায় দাঁড়াল, বলল, পরে কথা হবে।
লীলা ফিরে তাকাল না। তার দরকারও নেই। শ্যাম বোঝে।
সিঁড়ির চৌখুপিতে ওরা নেমে গেলে উঠে দাঁড়াল শ্যাম। তাড়াতাড়ি একটা ট্রে হাতে ছুটে এল বুড়ো বেয়ারা। বিরক্তিকরভাবে পথ আটকাল। পকেটে হাত দিয়ে খুচরো পয়সা যতখানি হাতে পেল, তুলে এনে ঝনাৎ করে তার ট্রে-তে ফেলে দিল শ্যাম। তারপর আর ফিরেও তাকাল না।
নীচে নেমে এসে দেখল কোথাও কেউ নেই, তাড়াহুড়ো করে ওদের খুঁজল না শ্যাম। ধীরে ধীরে হেঁটে এসে নিশ্চিন্ত মনে বাস ধরল।
হোটেলে ঢুকে ভূত দেখে আঁতকে উঠল শ্যাম। সুবোধ মিত্র! অনেককালের পুরনো বন্ধুর মতো হাসল মিত্র।
কাল আসেননি। শ্যাম জিজ্ঞেস করে।
না। মিত্র মাথা নাড়ে, কাল একটা বরযাত্রী গিয়েছিলুম।
শ্যাম উলটো দিকে মুখোমুখি বসে।
মিত্র বলল, কাল একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখলুম মশাই। বরযাত্রী গিয়েছিলুম পুটিয়ারি পশ্চিম না দক্ষিণ ঠিক মনে নেই, টালিগঞ্জের খাল পেরিয়ে যেতে হয়। ও-সব গ্রাম-গঞ্জ ছিল কিছুকাল আগেও। কিন্তু গিয়ে শুনলুম ওটাও নাকি কলকাতা…হাঃ হাঃ–দু’দিন পরে আপনি যে-দিকেই যাবেন, যতদূর যাবেন, দেখবেন কলকাতা আর কলকাতা…কলকাতার শেষ নেই আর…লাফিয়ে লাফিয়ে শহর বেড়ে যাচ্ছে মশাই, গ্রাম-গঞ্জ খেত-খামার যা পাচ্ছে হাতের কাছে তাতেই স্ট্যাম্প মেরে দিচ্ছেক্যালকাট্টা!…হাঃ হাঃ…বাড়তে বাড়তে একদিন এই কলকাতাই না দুনিয়াময় হয়ে যায়!…হাঃ হাঃ…এতকাল কলকাতার মাঝখানে থেকে টেরও পাইনি যে, কলকাতা কেমন বেড়ে যাচ্ছে চারদিকে! এর পর আর কলকাতার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও যাওয়া যাবে না মশাই, খুব অদ্ভুত ব্যাপার হবে, দেখবেন! তখন পাহাড়ে যাবেন তাও কলকাতায়, সমুদ্রে যাবেন তাও কলকাতায়; তখন কলকাতায় জন্মে সারাজীবন কলকাতাতেই ঘুরে মরবে লোক…হাঃ হাঃ…
খাওয়া হয়ে গেলে একসঙ্গে বেরোল দু’জন। শ্যাম গুনে দেখল আজ পনেরোটা কুকুর। সে হঠাৎ বলল, কুকুর খুব বেড়ে যাচ্ছে, দেখেছেন!
হা। মাথা নাড়ে মিত্র। হেসে বলে, আমাদের ম্যানেজার লোকটা খুব কুকুরভক্ত। তারপর একটু গলা নামিয়ে বলল, বোধহয় রোজ মহাভারত পড়ে…হাঃ হাঃ…
.
মিত্রকে গড়িয়াহাটায় ছেড়ে দিয়ে ঘরের দিকে ফিরল শ্যাম। দূর থেকেই দেখল বাসার সামনে রাস্তার ফুটপাথে অরুণ দাঁড়িয়ে আছে। তার টাইয়ের নট’ ঢিলে হয়ে গেছে, রাস্তার মৃদু আলোতে তার মুখটা লাল আর চোখ দুটো হতভম্ব দেখায়।
ওঃ শ্যাম! অরুণ সামান্য টলমলে পায়ে এগিয়ে আসে, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোকা-হাসি হাসে, ততার সঙ্গে কথা আছে…
শ্যাম তার হাত ছোঁয় না। দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তাকে দেখে। নিজের ভিতরে শীতল এক নিষ্ঠুরতাকে অনুভব করে সে। ঠান্ডা গলায় বলে, আয়।
হুইস্কির চেনা গন্ধ পায় শ্যাম। সামান্য অস্থির পায়ে অরুণ তার পিছনে হেঁটে আসে। আসতে আসতে কথা বলে, ওঃ, শ্যাম, আমার বড় কষ্ট রে। আমি আর পারছি না রে।