নিঃশব্দে লীলা বলে ওঠে, কাছে এসো।
শ্যাম আপনমনে মাথা নাড়ে। না। আমি জানি কাছে যেতে চেষ্টা করলে চারদিকের বাড়িঘর কেঁপে উঠবে, মাঠ ময়দান থেকে শিকড় ছিঁড়ে ছুটে আসবে গাছপালা, বাতাস আর্তস্বরে চেঁচিয়ে বলবে, রক্ষা করো, রক্ষা করো; আমি জানি, এখানে নয়, অন্য কোনও সুন্দর পৃথিবীতে আমাদের দেখা হওয়া ভাল। এখানেনয়— এত লোকজন আর এত ভিড়ের মধ্যে নয়। দেখো একদিন খুব শিগগিরই আমি পৃথিবীতে সুসময় এনে দেব।
সে লীলার নিঃশব্দ স্বর শুনতে পায়, কথা বলো।
না। মাথা নাড়ে শ্যাম। এখনও নয়। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যই আমি আলাদা একটা ভাষা তৈরি করব, দেখো। সেই ভাষায় থাকবে না কোনও কঠিন, রূঢ় কিংবা অশ্লীল শব্দ, তাতে থাকবে না কোনও গালাগাল। এখনও মানুষের ভাষা তেমন সুন্দর নয়। এখনও তাদের জানা বহু শব্দ রয়ে গেছে যা রহস্যময়, কিংবা যা রাগ ও বিদ্বেষের, যা অবহেলা কিংবা প্রত্যাখ্যানের। আগে তুমি সেই সব শব্দ ভুলে যাও, তারপর…
লীলা রাস্তা পার হল না। বাঁয়ে মোড় ঘুরল। কয়েক পা হেঁটে একটা খোলা দরজার সামনে দাঁড়াল হঠাৎ। পিছনে ফিরে অন্যমনস্ক চোখে একবার চারদিক দেখে নিল। তারপর দরজার ভিতরে চলে গেল।
শ্যাম ধীরে ধীরে দরজাটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিতরে কেবল দেখা যাচ্ছে একটা সরু সিঁড়ি স্টিমারের সিঁড়ির মতো সুন্দর, লোহার চকচকে পাত বসানো, মসৃণ রেলিং, খুব উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। সিঁড়িতে লীলা নেই। উঠে গেছে। নতুন রঙের গন্ধ পাওয়া যায়, আর মৃদু খুব মৃদু পাউডারের গন্ধ।
এটা কি রেস্তরাঁ।শ্যাম কয়েক পা পিছিয়ে এসে দরজার ওপরে দেখল— রেস্তরাঁ। সাইন বোর্ডে নাম লেখা আছে। শ্যাম জানে এখানে লীলার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে। শ্যামের জানা দরকার নোকটা কে! সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কোনও মোটর-সাইকেল দাড় করানো আছে কি না। নেই।
কোনও দ্বিধাই বোধ করল না শ্যাম। আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগল।
.
হলঘরের মতো প্রকাণ্ড একটা ঘর। এত উজ্জ্বল আলো জ্বলছে যে শ্যামের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পেয়ালা পিরিচ চামচ কিংবা টেবিলের কাচের চাদর থেকে ঠিকরে এসে আলো তার চোখে আলপিনের মতো বেঁধে। কিছুক্ষণ সে ভাল করে লীলাকে দেখতে পেল না। সে তার রুক্ষ চেহারা এবং এলোমেলো পোশাকে এই ঝকঝকে ঘরে বেমানান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর লীলাকে দেখতে পেল সে। প্রায় ফাঁকা রেস্তরাঁ। কয়েকটিই মাত্র লোক ছড়িয়ে বসেছে, একেবারে কোনও দূরের টেবিলে বসছে লীলা, টেবিলের ওপর অল্প নোয়ানো কাধ, মুখ নিচু—যেন টেবিলের কাচে সে তার মুখের ছায়া দেখছে। না, লীলা একা নয়, তার মুখোমুখি উলটো দিকের চেয়ারে বসে আছে সুন্দর চেহারার একটি লোক।
অরুণ না! ভ্রূ কুঁচকে শ্যাম দেখে, তারপরে মৃদু হাসে। হ্যাঁ, অরুণই।
অরুণ তাকে প্রথম দেখতে পেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো লাফিয়ে উঠল অরুণের, কপালে পড়ল ভাজ। মুখ সামান্য ফঁক হয়ে রইল একটুক্ষণ। শ্যাম বুঝল না, কেন এরকম হল অরুণের! সে মৃদু হাসিমুখে চেয়ে রইল অরুণের দিকে।
সামান্য ফিসফিস করে অরুণ বলল, শ্যাম! অনেকক্ষণ পর হাসল, আয়। আশ্চর্য যে, লীলা তার দিকে ফিরেও তাকাল না।
অরুণের ডাকটাকে গ্রাহ্য করল না শ্যাম। মাঝখানের তিনটে টেবিল সে বাদ দিয়ে বসল। একা। এক কাপ চায়ের কথা বলে দিল বুড়ো বেয়ারাকে।
আড়চোখে সব কিছু লক্ষ করে শ্যাম। অরুণের মুখ অল্প লাল। তাকে লাজুক আর ভিতু দেখাচ্ছে। খুবই আশ্চর্য হল শ্যাম। এরকম হওয়ার কথা ছিল না। তার নিজের অতীতের মতোই অরুণের চরিত্র–সে জানে। অন্য কোনও লোকের বদলে অরুণকে দেখে শ্যাম বরং স্বস্তি পায়। শ্যাম জানে যে, সে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ অরুণের কাছ থেকে লীলার কোনও ভয় নেই। শ্যাম নিজে অরুণের চেয়ে অনেক পাকা লোক ছিল।
সে লক্ষ করল, অরুণ কথা বলছে না লীলার সঙ্গে। সে কাঁটা চামচ দিয়ে এক টুকরো আলুর বড়া মুখে পুরে ভয়ংকর জোরে উত্তেজিত ভাবে চিবোচ্ছে। ঝনন করে তার চামচ পিরিচের সঙ্গে ঠুকে শব্দ করে ওঠে। অকারণে রুমালে মুখ মোছে অরুণ, তার চোখ লীলার নোয়ানো মাথার ওপর দিয়ে সামনের দেয়ালে ঘুরে বেড়ায়। সুন্দর চেহারা আর সুন্দর পোশাকে অরুণের ওই ভাবভঙ্গি খুব বেমানান লাগে শ্যামের কাছে।
লীলা খুব ঠান্ডা এবং সহজ ভঙ্গিতে বসেছে এখন। নোয়ানো মাথা তুলে অরুণের দিকে চেয়ে দেখছে। তার মুখে একটু স্মিত কৌতুকের ভাব। হঠাৎ সে তার একটু তীক্ষ্ণ পাখির মতো মিষ্টি গলায় স্বাভাবিকের চেয়ে একটু জোরে বলল, আপনি আমাকে ডেকেছিলেন।
অরুণ সামান্য অস্থির অস্বস্তির হাসি হাসে, মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
আমি এসেছি।
খুব মৃদু গলায় অরুণ কিছু বলল। শ্যাম শুনতে পেল না। শুধু দেখল, অরুণের কথার উত্তরে লীলা শুধু মাথা নেড়ে জানাল, না।
লীলাকে কেন এখানে ডেকে এনেছে অরুণ তা শ্যাম বোঝে। তবু লীলাকে খুব শান্ত ও দৃঢ় দেখায় যেন লীলার সঙ্গে আছে কোনও সমর্থ লোক, যে লীলাকে আপদে রক্ষা করবে। লীলার চোখে-মুখে সেই প্রত্যয় দেখে শ্যাম। লক্ষ করে, অরুণ তার শুকনো ঠোঁট চাটছে, এবং বোকার মতো এড়িয়ে যাচ্ছে শ্যামের চোখ। শ্যাম মৃদু হাসে। তার সামনের টেবিলে রাখা এক কাপ চা আস্তে আস্তে জুড়িয়ে যেতে থাকে।