.
চাকরি যাওয়ার পর থেকে যে পাইস হোটেলে দু’বেলা খাচ্ছিল শ্যাম, সেখানে সুবোধ মিত্রের সঙ্গে আলাপ। একদিন রাতে মুখোমুখি খেতে বসে মিত্র বলল, কী মশাই, সংসার-টংসার ছাড়ার মতলব আছে। নাকি? দাড়িফাড়ি না কামালে যে বড় উদাসীন দেখায় আপনাকে!
শ্যাম মৃদু হাসে, সংসার কোথায় যে ছাড়ব?
মিত্র বলে, কেন, আপনার তো মা-বাবা আছেন! তাদের জন্য এবার একটি ডবকা দেখে দাসী এনে ফেলুন।
সে তো আপনিও আনতে পারতেন।
মিত্রকে হঠাৎ খুব গম্ভীর দেখাল। একটু চুপ করে থেকে শ্বাস ছেড়ে বলল, আমার জীবনে একটা ট্রাজেডি আছে মশাই। বলে আবার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মিত্র মৃদু হেসে গলা নামিয়ে বলল, আমার মশাই, একটা লাভ অ্যাফেয়ার ছিল। সে মেয়েটা তার বিয়ের পর অনেক কেঁদেকেটে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল যেন বিয়ে না করি। তখন সেন্টিমেন্টের বয়স, তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলুম। কিন্তু এখন…মিত্র খাস ছেড়ে বলল, এখন ভাবি কী-সব বোকামি! এ-সব প্রতিজ্ঞার কোনও দাম নেই, কী বলেন?
শ্যাম মোলায়েম গলায় বলে, দূর দূর…
মিত্র নিশ্চিন্ত গলায় বলে, কী জানি মশাই, এখনও কেমন যেন খচখচ করে মনে মধ্যে—
শ্যাম বিস্মিত গলায় বলে, শব্দ হয়?
অ্যাঁ? অন্যমনস্ক মিত্র কথাটা খেয়াল করল না।
শ্যাম মাথা নেড়ে বলল, কিছু না।
হঠাৎ আগ্রহে ঝুঁকে পড়ে মিত্র বলল, আমার বয়স তেত্রিশ। আমরা মশাই ময়মনসিংহের মিত্র। ঝাড়া হাত পা, একটি বোন ছিল, কাচড়াপাড়ায় বিয়ে দিয়েছি, ছোটভাই সাহারাণপুরে ফিটার, ভাল ফুটবল খেলত। ছিলুম মা আর আমি। তা মা মারা গেলে একটি চাকর রেখে চালাচ্ছিলুম, সে চুরি করতে শুরু করায় তাকে ছাড়িয়ে দিয়ে এই হোটেলে জুটেছি, কিন্তু এখন মশাই পেটে সইছে না। তা ছাড়া মা মরে গিয়ে বাসাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে… বলে একটু দুঃখের হাসি হাসল মিত্র, আমার মশাই দাবি-দাওয়া নেই। একটু দেখবেন তো…।
এত কথা শুনছিল না শ্যাম। মিত্রের বয়সের কথায় তার মন আটকে ছিল। মিত্রের বয়স তেত্রিশ। তার সন্দেহ হল যে, বিয়ের লোভে মিত্র অন্তত সাত-আট বছর বয়স কমিয়ে বলছে।
মিত্রের এঁটো ডান হাত শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে এসেছিল। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ ঘেন্নায় লাফিয়ে উঠল শ্যাম, বলল, দেখব। তারপর আঁচাতে গিয়ে বেসিনের ওপর আয়নায় নিজের মুখখানা এক পলকে দেখে নিল সে। তেলতেল করছে তার মুখ, অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি, অনেক দিন তেল বা শ্যাম্পু না দেওয়া রুক্ষ চুলে তাকে পাগলাটে দেখায়। হাত-আয়নায় রোজ সে মুখ দেখে, কিন্তু এই বড় আয়নায় তাকে অন্য রকম দেখায়। তার মনে হয়, তার দু চোখে এক ধরনের পরিবর্তন এসে যাচ্ছে।
আঁচিয়ে এসে মৌরি মুখে দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। ডিসেম্বরের শীতরাত্রির ফুটপাথে সে কয়েকটা ঘুমন্ত ঘেয়ো কুকুরকে ডিঙিয়ে গেল, পেরিয়ে গেল গাড়ি-বারান্দার তলায় শুয়ে থাকা জড়োসড়ো কয়েকটা ভিখিরিকে, যেতে যেতে বাড়ির দেয়ালগুলোতে হাত রেখে শিস দিল সে। সামনেই একটা পার্ক—শীত আর ঘন কুয়াশায় জমে আছে। রেলিং টপকে সে ভিতরে ঢুকল। বেঞ্চিগুলি কঁকা পড়ে আছে। শ্যাম বসে সিগারেট ধরায়। পায়ের স্যান্ডেল ঘাসের শিশিরে ভিজে গেছে, পা বেয়ে শিরশির করে উঠে আসছে শীত, কুয়াশায় দম-চাপা ভাব আর কাঠ কিংবা কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ। শ্যাম নিশ্চিন্ত। মনে বসে থাকে, ঘড়ির দিকে তাকায় না, তার মন গুনগুন করে ওঠে—-উদাসীন, বড় উদাসীন দেখায়। তোমাকে শ্যাম!
আকাশে তারা না, মেঘ না, কিছুই দেখা যায় না। শুধু ধোঁয়ার মতো কুয়াশা তাকে ঘিরে ধরে। বহুদূর দিয়ে মন্থর বিষণ্ণ ট্রাম চলে যাওয়ার শব্দ হয়, টুপটাপ করে অন্ধকারে কোথাও গাছের পাতা কি শিশির ঝরে পড়ে। দূরে কোনও ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীণ আভা লেগে কুয়াশা সামান্য হলদে হয়ে আছে, এত ক্ষীণ সেই আলো যে, তাতে শ্যামের ছায়াও পড়ে না। শ্যামের মনে হয়, জীবনের সবচেয়ে সুসময় এইটাই যা সে পেরিয়ে যাচ্ছে। ভেবে দেখলে এখন তার মন উচ্চাশার হাত থেকে মুক্ত। তার চাকরি যাওয়ার পর ছ’ মাস কেটে গেছে। হাতের জমানো টাকা ফুরিয়ে আসছে ক্ৰমে। তবু তার কোনও উদ্বেগ নেই। কোনও দুশ্চিন্তাই সে বোধ করছে না। তার পরনে ধুতি-শার্ট আর কবেকার পুরনো একটা এন্ডির চাদর। ছ’ মাস আগে এ-পোশাকে বেরোনোর কথা তার কল্পনায়ও আসত না। দুপুরে তার অফিসে ছিল বাঁধা লাঞ্চ, রাত্রে খাওয়ার স্থিরতা ছিল না তার কোম্পানির মক্কেলদেরই কেউ না কেউ তাকে বড় হোটেলগুলিতে নিয়ে যেত। না, সে সৎ ছিল না, এখনও তার সততার প্রতি কোনও মোহ নেই। ইচ্ছে করলে এবং প্রয়োজন হলে এখনও সে যে-কোনও কাজ করতে পারে, যে-কোনও পাপও। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এখন আর তার ইচ্ছাগুলির কোনও জোর নেই, না আছে কোনও স্পষ্ট প্রয়োজনবোধ। কী করে, কখন কবে তার উচ্চাশাগুলি নষ্ট হয়ে গেছে, কীভাবেই বা কেটে গেছে উদ্বেগ তা সে টেরও পায়নি। নিজেকে বড় উদাসীন মনে হয় তার। হঠাৎ সুবোধ মিত্রের কথা মনে পড়লে সে ‘আঃ শব্দ করে অন্ধকারেই আপনমনে হেসে উঠল। চল্লিশে এসে মিত্র কাঙালের মতো বিয়ের কথা পাড়ছে এলোপাথাড়ি, পাইস হোটেলে মুখোমুখি খেতে বসে। ইচ্ছে করে মিত্রের কাছে গিয়ে সে তার প্রেমের কাহিনীগুলি শুনিয়ে আসে। হ্যাঁ মশাই, সে-সব মেয়ে কথা আপনি ভাবতে পারবেন না। বৃন্দাকে প্রথম দেখি পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তরাঁয়, সঙ্গে ভালমানুষ গোছের একটি প্রেমিক ছেলে। দু’বার, ঠিক দু’বার সে তাকিয়েছি আমার দিকে—ঈশ্বরকে ধন্যবাদ—যে দিক থেকে আমার মুখশ্রী সবচেয়ে ভাল দেখায়, সেই দিকটাই ফেরানো ছিল তার দিকে; যা মশাই, বাঁ দিক থেকেই আমাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। আমি তারপর সোজা উঠে গেলুম তাদের টেবিলের কাছে, বৃন্দার দিকে চোখ রেখে আমি ছেলেটার দিকে হাত বাড়ালুম—দেশলাইটা। বিরক্তির সঙ্গেই বোধহয় ছেলেটি দেশলাই এগিয়ে দিলে। অপ্রয়োজনে সিগারেট ধরাতে ধরাতে আমি বৃন্দার দিকে চেয়ে একটু হেসেছিলাম। সেই হাসি আমি শিখেছিলুম কলকাতার সবচেয়ে সেরা বদমাশদের কাছ থেকে। অনেক বার ও রেস্তরাঁ ঘুরে তা আমাকে শিখতে হয়েছিল। তার পরদিন বৃন্দা সেই রেস্তরাঁয় এসেছিল একা। কী করে সে তার প্রেমিক সঙ্গীটিকে কাটিয়ে এসেছিল তা আমি আজও জানি না। হ্যাঁ মশাই, তারপর বৃন্দাকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পেরেছিলুম। কিংবা মাধবীর কথা ধরা যাক–যাকে আমি প্রথম দেখি এক ফিল্ম ক্লাবের শোতে। যার নীল রঙের প্লিমাউথ গাড়িটাকে আমার ভাড়াটে ট্যাক্সি বাঘের মতো তাড়া করেছিল। তারপর মাধবীকেও একদিনা মশাই, তারপর মাধবীও একদিন বলেছিল—দিন দিন তুমি কী হয়ে যাচ্ছ শ্যাম, তুমি ইতরের মতো তাকাতে শিখেছ বলতে বলতে সে তার নরম মেরুদণ্ড পিছনে হেলিয়ে। ভেঙে দিয়েছিল সবুজ ডিভানে। তবু বলি, আমার মন ছিল হাঁসের শরীর। আমার শরীরের ভিতরে ছিল বিশুদ্ধ বাতাস, আর উজ্জ্বল রক্ত। কোনও দিন কখনও কোনও মেয়ের জন্য আমি হাঁটু ভেঙে প্রার্থনায় বসিনি। বলিনি—দয়া করে আমাকে ভালবাসো। কেননা তার দরকার ছিল না। শুধু ওই মেয়েটি, ওই আটপৌরে ইতু কোনও দিনই বিয়ে করার কথা ভুলতে পারল না। যেমন পারেননি আপনি। কেমন সেই মেয়ে যার প্রেমে আপনি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত টিকে গেলেন। প্রেমের নামে আমি মশাই শিস দিই, আমার চোখ ইতর হয়ে যায়, আমার ঠোঁটে ফুটে ওঠে সেই হাসি। আমি প্রেম ওইরকম বুঝি মশাই। আমার কেবল ভয় ওই আটপৌরে মেয়েদের, চার দিন কথা বলার পর যারা পাঁচ দিনের দিন মিনমিন করে বলে, বাবা বলছিল, ছেলেটাকে একবার নিয়ে আসিস তো খুকি, দেখব। হাগো মিত্তিরমশাই, আপনার জুলিয়েটটি কেমন ছিল? ওই রকম আটপৌরে তো, শেষ পর্যন্ত দেখুন এত বয়সেও আপনাকে হাফ-সন্ন্যাসী করে রেখে গেছে! বিয়ে করবেন? তা আপনার কপালে ওইরকম আটপৌরেই জোটার সম্ভাবনা, যে আর-একজন সন্ন্যাসী বানিয়ে আপনার ঘর করতে আসবে নিশ্চিন্ত মুখে। তার সেই প্রেমিকের স্মৃতি তার চন্দনের হাতবাক্স বা গোপন চিঠির মতো, মাঝে মাঝে পানের বাটার সামনে বসে না ছেলে মানুষ করতে করতে মনে মনে নেড়েচেড়ে দেখবে। ঈশ্বর! আমার ভাগ্য ভাল যে, আমার শরীরের ভিতরে এখনও রয়েছে বিশুদ্ধ বাতাস, আর উজ্জ্বল রক্ত। কখনও কোনও মেয়ের জন্য আমি হাঁটু গেড়ে বসিনি প্রার্থনায়। আমার মন মশাই, হাঁসের শরীর। হ্যাঁ, চমৎকারভাবেই আমি এতকাল মেয়েদের ব্যবহার করে এসেছি। আঁচলের গেরোয় বাঁধা পড়িনি। আমি নিষ্কলঙ্ক ও বিশুদ্ধ। আজ আমার দুরবস্থা দেখে ভাববেন না। সেই তরমুজ বিক্রেতার কথা ভেবে দেখুন, যে বলেছিল, আমরা কি ভগবানের হাত থেকে কেবল ভালটাই গ্রহণ করব, মন্দটা নয়? তা আমার অবস্থা এমন কিছু খারাপও নয়। চাকরি নেই, কিন্তু যে-কোনও সময়ে চাকরি হয়ে যেতে পারে। দরকার একটু ঘোরাঘুরির উৎসাহ। দাড়িটা যদি কামাই, ছ’ মাস আগেকার প্যান্ট-শার্ট-টাই যদি গায়ে দিই, আর চোখের সেই অভ্যস্ত চাউনি আর হাসিটা যদি দু-একদিন অভ্যেস করে নিই, তবে অল্পদিনেই আবার আমার চারদিকে চাঁদের জেল্লা লেগে যাবে। হায়, শুধু কেবল কেন যেন উৎসাহ পাই না আর! আঃ, আমার হাই উঠছে।