লোকটার ভ্রূ সামান্য কুঁচকে ওঠে। তারপর মুখ ফিরিয়ে সে হাঁটতে থাকে। এলোমলো রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে হেঁটে যায়। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে শ্যামকে লক্ষ করে। খুবই উত্তেজনা বোধ করে শ্যাম। তারপর অবশেষে লোকটা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের কাছে এসে একটা বড় বাড়ির মধ্যে সোজা গট গট করে হেঁটে গেল। লোকটা ভয় পেয়ে গেছে-ভাবে শ্যাম। আবার তার শরীরে শীতভাব ফিরে আসে। হতাশ বোধ হয়।
শূন্য মনে খানিকটা ঘুরে বেড়ায় শ্যাম। তারপর একটা ফাঁকা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে। শান্তভাবে চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে থাকে। তার সামনে এক কাপ গরম চা জুড়িয়ে জল হয়ে যায়।
পাশের টেবিল থেকে একজোড়া সিন্ধি ব্যবসায়ি উঠে গেল, অন্য ধারে এসে বসল চর্বির পাহাড় গলায় থাক থাক গলকম্বলওয়ালা এক পাঞ্জাবি। ঘুম ঘুম চোখে একবার শ্যামকে চেয়ে দেখল।
বাইরে ছায়াহীন বোদ গড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তায়, ওধারের বাড়ির আলসে থেকে পিছলে পড়ে পাখা মেলে দিল একটা পায়রা, ঠক ঠক করে হেঁটে গেল দুটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে।
উঠে পড়ে শ্যাম। কাউন্টারে দাম দিয়ে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময়ে দরজার চৌকাঠে তার মুখের ওপর একটা ছায়া এসে পড়ে। বিদ্যুৎবেগে লাফিয়ে ওঠে শ্যামের হৃৎপিণ্ড— সেই লোকটা! পিছনে ঝকমক করছে রোদ, লোকটার মুখ তাই অন্ধকার দেখায়। হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে শ্যাম এক পা পিছু হটে আসে। লোকটা এক পা এগিয়ে আসে, শ্যাম।
না, সে লোকটা নয়। পরনে নেভি ব্লু সুট, গলায় বো, সুন্দর চেহারার ফরসা একটা লোক শ্যামের সামনে দাঁড়ায়।
অরুণ! যেন ড়ুবে যাচ্ছিল শ্যাম, এমন ব্যগ্র হাত বাড়িয়ে অরুণের একখানা হাত চেপে ধরে সে, আঃ, অরুণ!
ইসস! তোকে চেনাই যায় না!
তুই! শ্যাম অরুণকে ভাল করে দেখে, তুই খুব সুন্দর হয়ে গেছিস।
দূর! মৃদু হাসে অরুণ, অ্যালকোহলিক ফ্যাট। তোর কী খবর?
ভাল। শ্যাম মাথা নাড়ে।
কিন্তু তোকে ভাল দেখাচ্ছে না। দাড়ি-ফাড়ি দিয়ে চেহারাটা কী যে বানিয়েছিস! বলতে বলতে শ্যামের হাত ধরে টেনে নেয় অরুণ। দু’জনে মুখোমুখি বসে। বসেই অরুণ বলে, শুনেছি ঝগড়া করে চাকরি ছেড়েছিস!
শ্যাম নিঃশব্দে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
অথচ তুই কী ভীষণ ড্যাশিং পুশিং ছিলি! কত ওপরে উঠে যাওয়ার কথা ছিল তোর। আর কী দশা করেছিস নিজের।
শ্যাম চুপ করে থাকে।
শালার বস আমারও ছিল তেরিয়া, তাই বাঁচার জন্য একদিন তার কালো কুচ্ছিত মেয়েটাকে নিয়ে লম্বা দিলুম। লোকটা চেঁচামেচি করল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনেও নিল।…দুটো লিফট পেলুম পর পর।…একটা দুঃখ ভাই, ছেলেবেলা থেকেই একটা সুন্দর বউয়ের শখ ছিল আমার। সেটা হল না। বলতে বলতে মৃদু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে অরুণ, তবে পুষিয়ে নেব, দেখিস। ফেব্রুয়ারিতে চললুম আমেরিকা…বউকে রেখে যাচ্ছি তার বাপের বাড়িতে…।
চেয়ে থাকে শ্যাম। অরুণকে খুব ফরসা দেখাচ্ছে। সাহেবি পোশাকের জন্য নয়, রং ফরসা বলেও নয়, শ্যাম লক্ষ করে দেখে, চোখে-মুখে কেমন এক ধরনের বিদেশি ছায়া পড়েছে অরুণের। হঠাৎ তাকে খুব দূর বিদেশের অচেনা লোক বলে মনে হয়।
চা শেষ করে উঠে পড়ে দু’জনে।
কোথায় যাবি? রাস্তায় এসে অরুণ জিজ্ঞেস করে।
শ্যাম মাথা নাড়ে, জানি না।
দূর শালা! অরুণ হাসে, তুই কেমন ম্যান্দা মেরে গেছিস! আমার সঙ্গে চ…
কোথায়? খুব নিস্তেজভাবে বলে শ্যাম।
চোখ নাচিয়ে অরুণ হাসে, ভাল জায়গা। সাহেবের অফিস। সুন্দরী রিসেপশনিস্টের মুখোমুখি বসে থাকবি। ভিসার ব্যাপারে এক মার্কিন সাহেবকে ধরা-করার ব্যাপার আছে—আধঘণ্টার কাজ। চ–
রাস্তায় একটা ছোকরা জুতো-পালিশওয়ালাকে দিয়ে জুতো পালিশ করিয়ে নিল অরুণ। ঝুঁকে পালিশওয়ালাকে বলল, দ্যাখ জুতোয় তোর মুখ দেখা যাচ্ছে?
ছেলেটা ঝুঁকে মুখ তুলে হাসল, জি হাঁ।
তব ঠিক হ্যায়। বলে অরুণ পয়সা দিয়ে দেয়। হাঁটতে থাকে।
নিজের ভিতরে এক অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করে শ্যাম। যেন সব কাজ, আনন্দ এবং উৎসাহ থেকে অবসর নেওয়া হয়ে গেছে। এখন চলেছে তার অবসরের ধীরগতি জীবন। শরীরের মধ্যে যেন বিকেল হয়ে এল। এখন সেই সময়, যখন তার অফুরান ছুটি, আর সে তার ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে বসে রাস্তার চলমান দৃশ্য দেখে যাবে, কোনও দৃশ্যের মধ্যে আর রাখবে না নিজেকে। চটপটে অরুণের সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে তাই তার কষ্ট হচ্ছিল, হাঁফ ধরে গেলে সে বলল, আঃ অরুণ, আস্তে হাট।
কয়েক পা এগিয়ে-থাকা অরুণ পিছু ফিরে চায়, তুই শালা মেদিয়ে গেছিস। কোথায় সেই চটপটে লেফট আউট! কোথায় তোর কুইক রিফ্লেক্স! হা হা করে খোলা রাস্তাতেই হাসে অরুণ, তুই কি বুড়ো?
না। মাথা নাড়ে শ্যাম, আমার কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। মনে মনে সে গুনগুন করে, থেমে গেলেই তুমি দুয়ো…থেমে গেলেই তুমি বুড়ো… থেমে গেলেই তুমি মাটির ঢেলা…কাকে কবে কোথায় যেন বলেছিল শ্যাম!
চমৎকার সাজানো-গোছানো রিসেপশন রুমে তাকে বসিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেল অরুণ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেই ঘরে গদির সোফায় বসে রইল শ্যাম, তার আশেপাশে আরও কয়েকজন লোক, রিসেপশন কাউন্টারের ওধারে একটি মেয়ে টেলিফোন আর ভিজিটর নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ঠিকই বলেছিল অরুণ মেয়েটি বড় সুন্দর। কাঁধ থেকে দীর্ঘ দু’খানা শূন্য সাদা হাত মদরঙের কাঠের পালিশে ছায়া ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে—টেলিফোনের চাবির বোর্ড থেকে খোলা কাগজে, নোট-বইয়ে। গাঢ় বেগুনি রঙের ব্লাউজ, গাঢ় বেগুনি তার শাড়ি, ফাঁপানো চুল ঘাড়ের নীচে আলগা একটা ফিতের গিট দিয়ে বাঁধা। মুখের ধাঁচ গোল, কপাল-ঢাকা চুল, ছোট্ট একটু সিথি। ফুটফুট করছে তার মুখ-চোখ।-সেই মুখ-চোখ কথা বলছে নিঃশব্দে–আমি খুব বেঁচে আছি। দেখো, রাতে আমি নিঃসাড় ঘুমিয়েছি। জানো, আমার এখনও বয়স হয়নি। আমার কোনও অসুখ নেই। আমি ভোরে স্নান করি, ড়ুব দিয়ে! আমি তোমাদের অচেনা।