না, বহুকাল আর সেই ছবি বের করে দেখে না শ্যাম, আগে মায়ের জন্য কাঁদত, পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে কিংবা নতুন চাকরিতে যাওয়ার সময়ে প্রণাম করে যেত ওই ছবি। তারপর আস্তে আস্তে কপূরের গন্ধের মতো মন থেকে মুছে গেছে ওই দুটি মুখ। মনে পড়ে না, আর তেমন করে মনে পড়ে না। কেবল মাঝে মাঝে হরিধ্বনি দিয়ে যখন মড়া নিয়ে যায়, তখন চমকে উঠে মনে পড়ে কুয়োতলা, ঘাটে যাওয়ার মেঠো পথ, করমচার গাছ, পরে লাফিয়ে পড়ছে ব্যাঙ; মনে পড়ে, প্রকাণ্ড এক অন্ধকারের মধ্যে উত্তরের ঘরের দাওয়ায় ছোট্ট একটু হ্যারিকেনের আলো কোলে করে মা বসে আছে মুখের চামড়ায় নেমেছে শিকড়বাকড়, কথা বলতে গেলে মাথা কাপে—সামনের অন্ধকার, এক-আকাশ অস্পষ্ট নক্ষত্র, আর রক্তের মধ্যে অতি দুর্বোধ্য মৃত্যুর হিম অনুভব করতে করতে অসহায় মা বীজমন্ত্র ভুলে গিয়ে বিড়বিড় করে বলে চলেছে—”মনু, মনু রে, অ মনু মনু…মনু, মনু রে, অ মনু…’।
মনে মনে শ্যাম প্রশ্ন করে, তুমি আমার কে? তোমরা কারা? না, আমি তোমাদের চিনি না। তারপর চমকে ওঠে সে, অস্থির হয়ে আবার বিড়বিড় করে বলে, তোমরা ভাল থেকো। বেঁচে থেকো। আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমি ভাল আছি। আমি খুব ভাল আছি। দেখো, একদিন খুব সুসময় এসে যাবে। ভাল জমিতে আমরা তুলব ঘড়বাড়ি, তৈরি করব বাগান, মাছ ছেড়ে দেব পুকুরে, ছাড়া জমিতে বসিয়ে দেব জ্ঞাতিদের ঘর, এক-আধজন বোষ্টম, আর ধোপানাপিত। দূর বিদেশ থেকে আমি তোমাদের কাছে ফিরে আসব, আমি নৌকো বোঝাই করে নিয়ে আসব সুদিন…। সেই কবে ছেলেবেলায় শোনা ঘুমপাড়ানি গান গুনগুন করে শ্যাম, মায়রে দিলাম ডবল শাঁখা, ভাই করাইলাম বিয়া, বাপরে দিলাম সোনার মটুক, তীর্থ কর গিয়া…
০৭. ঠিক দুপুরবেলা গড়িয়াহাটার মোড়
ঠিক দুপুরবেলা গড়িয়াহাটার মোড় থেকে একটা লোকের পিছু নিল শ্যামা অকারণে। লোকটা কালো, হাড়গিলে রোগা চেহারা, অত্যন্ত কর্কশ তার মুখ, সেই মুখে মোটা গোঁফ, চোখে গগলস; পরনে টেরিকটনের গাঢ় রঙের চাপা চোঙা প্যান্ট, গায়ে ঝকঝকে ক্রিম রঙের সিল্ক শার্ট, হাতে ফোলিও ব্যাগ। চমৎকার ঝকমকে পোশাকের ভিতরে কালো হাড়গিলে লোকটাকে বেমানান এবং আরও কুচ্ছিত দেখাচ্ছিল যেন কারও জামাকাপড় চুরি করে এনে পরেছে।
লোকটা বাটার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ জুতো দেখল, তারপর শ্লথ গতিতে হেঁটে গেল মোড় পর্যন্ত, সিগারেটের দোকান থেকে কিনে নিল এক প্যাকেট সস্তা সিগারেট, কাপড়ের দোকানের ডামির দিকে চেয়ে একটু হাসল আপনমনে, একটা কান ভিখিরিকে তাড়া দিল,দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ করল একটি সুন্দরী মেয়ের চলে যাওয়া। তারপর ধীর গতিতে রাস্তা পার হয়ে ট্রামস্টপের দিকে চলে যাচ্ছিল লোকটা।
আগাগোড়া লোকটাকে লক্ষ করছিল শ্যাম। মনে হয় খুব সহজ শান্ত ও ভদ্র জীবন যাপন করে না লোকটা। চার দিকে ওর সতর্ক চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে ওরনের লোকই ভদ্রলোকদের পকেট হাতড়ে দেখে, কিংবা নিদেন সবার অলক্ষ্যে মেয়েদের নরম বুক ছুঁয়ে সরে যায়। একটা কিছু এধরনের কাজ করবেই লোকটা। শ্যাম নিশ্চিত। সামান্য উত্তেজনা বোধ করে শ্যাম, লোকটাকে চোখে চোখে রাখে, পিছু নিয়ে এসে ট্রাম-স্টপে দাঁড়ায়। লোকটা সবুজ রুমাল বের করে অকারণে ঘাড় গলা মোছে, স্টপে দাঁড়ানো মেয়েদের লক্ষ করে চোখেমুখে চিকমিক করে ওঠে কামনা-বাসনা। কিন্তু কিছুই করে না লোকটা।
ট্রামে উঠেও লোকটা খুবই ভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েদের কাছে ঘেঁষে না, ভদ্রলোকদের পকেটের দিকে তাকায় না।
এন্ডির চাদরের ভিতরে শ্যামের হাত মুঠো পাকিয়ে যায়, সে মনে মনে বলে, এবার একটা কিছু করো হে, আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। ভয় কী! ওই যে মোটা মতো লোকটা, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, ঘাড়ের চুল পুলিশদের মতো করে ছাঁটা, লক্ষ করে দ্যাখো লোকটা ঢুলছে। ওর বুক-পকেট থেকে মুখ বের করে আছে একটা খাম। ওটা তুলে নাও। কিংবা ওই যে মেয়েটা উঠে দাঁড়াল, পরনে মভ রঙের শাড়ি, মাথায় বিড়ে-খোঁপা, ওর চোখ-মুখ দ্যাখো– সুন্দর নয়, কিন্তু বাঘিনীর মতো কামুকা— জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটা ওর স্বভাব— ওর গায়ে তুমি নিশ্চিন্তে হাত দিতে পারো কিছুই হবে না। ভয় কী?
কিন্তু লোকটা খুব ভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে থেকে একটু কুঁজো হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তাঘাট দেখবার চেষ্টা করে। শ্যাম হতাশ হতে থাকে। এমন পাকা বদমাশের মতো চেহারা তোমার!–শ্যাম বলতে থাকে, তুমি শুধু চোখ দিয়ে যে-কোনও মেয়েকে গর্ভবতী করে দিতে পারো, শুধু চোখের ইশারায় তুমি তুলে নিতে পারো আমাদের পকেটের মনিব্যাগ। দেখাও। সেই ম্যাজিক দেখাও। ভয় কী হে! বাক আপ! চিয়ারিও!
তবুও লোকটা দাঁড়িয়েই থাকে। তার অন্যমনস্ক চোখেমুখে নরম এক ধরনের কবিত্বের ভাব ফুটে ওঠে। খুব হতাশ হয়ে শ্যাম লক্ষ করে যায়।
তবু শ্যাম পিছু ছাড়ল না।
লোকটা গ্র্যান্ড হোটেলের উলটো দিকে নেমে পড়ে। তারপর রাস্তা পার হয়ে বড় রাস্তা ধরেই অনেক দূর হেঁটে যায়। সুরেন ব্যানার্জি রোডে ঢুকে পড়ে। একটু দূরে থেকে শ্যাম হটতে থাকে। লোকটা একবার ঘাড় ঘোরাতেই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু হাসির চেষ্টা করে শ্যাম, হাসি দিয়েই বোঝাতে চায়–ভয় পেয়ো না, আমি শুধু দেখতে চাই যে, তুমি একটা কিছু করো। তুমি করিতকর্মা লোক–কিছু করো হে! বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ধরব না বা ধরিয়ে দেব না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারো তুমি।