ক্রমে শ্যাম বুঝল এইসব ফার্মগুলোতে নালী ঘায়ের মতো মজুমদারের খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে। মাস তিনেক পর আবার সামান্য ক্লান্তি ও মাথাধরা পেয়ে বসল তাকে। একদিন ভিড়ের এক চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে বিকেলের মরা আলোর দিকে চেয়ে সে বিড়বিড় করে বলল, আমি শেষ হয়ে গেছি। পরমুহূর্তেই চমকে উঠে সে দ্রুত এলোপাথাড়ি হাঁটতে লাগল।
আর-একদিন সে হাত-আয়নাটা মুখের সামনে ধরে জিরাফের মতো গলা বাড়িয়ে ডান হাতের চকচকে একটা সুন্দর ব্লেড কণ্ঠনালীর ওপর রাখল। সামান্য একটু চাপ দিল। বড় আরাম! কিছুক্ষণ পর সরু রক্তের কয়েকটা রেখা তার গেঞ্জির ওপর নেমে বুক ভাসিয়ে দিল। ব্লেডটা ছুড়ে ফেলে সে হেসে আপনমনে বলল, ধ্যৎ, বড্ড নাটুকে। তারপর তোয়ালে দিয়ে গলা মুছে ডেটল লাগাল। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল, রাস্তায় জীবন্ত মানুষজন চলাফেরা করছে। ক্ষতের ওপর ভেজা তুলো চেপে সে চোখ বুজল। আঃ! বড় আরাম।
তার দুটি শৌখিনতা ছিল। টেলিফোন করা, আর সকালে রোজ দাড়ি কামান। অফিসে তার টেবিলে যখন নিজস্ব টেলিফোন থাকত তখন সে একটু অবসর পেলেই প্রায় অকারণে একে-ওকে-তাকে ফোন করত। কতজনকে যে সে তার ফোনের নম্বর দিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। টেলিফোনে লোকের গলা শুতে, আর টেলিফোনের জন্যই তৈরি করা কৃত্রিম গলায় কথা বলতে তার ভাল লাগত। চাকরি যাওয়ার ছ’ মাসের মধ্যে সে টেলিফোন করল মাত্র দুটি। প্রথমটা করল কলেজ স্ট্রিট ওয়াই এম সি এ থেকে তার অফিসে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা কবে পাওয়া যাবে তা জানতে। দ্বিতীয়টা করল শিয়ালদার স্বয়ংক্রিয় বুথ থেকে ইতুকে, যার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় দক্ষিণ কলকাতার এক রেস্তরাঁয়, এবং যাকে কয়েকবারই সে তার শোওয়ার ঘরে নিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের মেলামেশাটা, যা ঠিক প্রেম নয়, তা বিয়েতে একটা রফায় পৌঁছুতে পারত। তাদের এ রকম কথাবার্তা হল।
শ্যাম, ইতু! কেমন আছ?
ইতু, ভাল না। তোমার দেখা নেই দু’ মাস!
আমার খোঁজ করেছিলে?
হ্যাঁ, অফিসে প্রায় মাস দুই আগে টেলিফোন করেছিলুম।
ওরা কী বলল?
বলল, তোমাকে…তোমাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে।
শ্যাম একটু ভেবে বলল, কথাটা ঠিক নয়। আমিই ছেড়ে দিয়েছি।
কেন?
হি কল্ড মি নেন।
হুঁ।
দি বস, দি বাস্টার্ড।
ইতু একটু চুপ থেকে বলল, এত দিন কী করছিলে? চাকরির খোঁজ!
হুঁ।
কিছু পেলে? বেটার কিছু?
ন্ন্ন্নাঃ।
এখন কী করবে?
শ্যাম মৃদু হাসল, ভাবছি বিয়ে করলে কেমন হয়। ইটস্ হাই টাইম।
বেশ তো! কাকে?
তুমি রাজি আছ?
হুঁউ। এক্ষুনি। বলতে বলতে ইতুর গলায় খুব আবেগ এসে গেল, মহীয়সী মহিলার মতো শোনাল তার গলা, শ্যাম, আমিও ছোটখাটো একটা চাকরি করি, তা ছাড়া আমার কিছু গয়না আছে। আমাদের দু’জনের…
শুনতে শুনতে শ্যাম খুব ধীরে ধীরে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে আনল, তারপর ঘুমন্ত বাচ্চাকে মা যেভাবে শোওয়ায় সেইরকম সন্তর্পণে ক্যাডেলে রেখে দিল ফোনটা।
আজকাল প্রায়ই শ্যামের মুখে দাড়ি বেড়ে যায়। সেই চাপা চিবুক, গভীর খাঁজওয়ালা সুন্দর থুতনি, ঝকঝকে মুখে সামান্য নিষ্ঠুরতা—যা তাকে আকর্ষণীয় করে তুলত, তা মাত্র কয়েক দিনের নাকামানো দাড়ির তলায় চাপা পড়ে যায়। বড় নিরীহ ও অসহায় দেখায় তাকে। কার্যকারণসূত্র জানে না শ্যাম, তবু তার মনে হয় দাড়ি কামানো না থাকলে চোখ দুটোকেও কেমন যেন একটু ঘোলাটে আর অনুজ্জ্বল দেখায়।
সময় কাটে না বলে শ্যাম মাঝে মাঝে বাসে উঠে টার্মিনাস থেকে টার্মিনাস পর্যন্ত ঘুরে আসে। সুন্দর সময় কেটে যায়। একদিন বালিগঞ্জ থেকে শ্যামবাজারের বাসে উঠেছিল শ্যাম। ভবানীপুরে বাস বিকল হল। বিরক্ত না হয়ে শ্যাম ধীরে সুস্থে নেমে পড়ল। ঘড়িতে সময় দেখল, আড়াইটে। সামনেই একটা ফাঁকা সিনেমা হল। ছবির নামটাও পড়ল না শ্যাম, বাইরের আঁকা ছবিগুলোর দিকে ফিরেও তাকাল না, টিকিট কেটে ঢুকে পড়ল। নিশ্চিত ফ্লপ ছবি, লোকে দেখছে না। আধো অন্ধকার হলের ভিতরে পা দিতেই একটি টর্চের আলো আর একটা ভুতুড়ে হাত এগিয়ে আসে। নিশ্চিন্ত মনে টিকিটটা লোকটার হাতে গুঁজে দেয় শ্যাম, তারপর তার পিছু পিছু চলতে থাকে। সিট দেখিয়ে লোকটা ফিরে যাচ্ছিল, শ্যাম ডাকল, মানুমামা না? টর্চ হাতে লোকটা চমকে ফিরে তাকাল, আরে! শ্যাম! এই সিনেমা হলেই যে মানুমামা কাজ করে তা শ্যাম বার বারই ভুলে যায়। মনে পড়ে, বেশ কিছুদিন আগে সে বৃন্দা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে এখানে ছবি দেখতে এসেছিল একদিন, মানুমামার কথা তার খেয়াল ছিল না। সেদিনও মানুমামা সিট দেখিয়ে দিয়েছিল। বুদ্ধিমান মানুমামা সেদিন তাকে চিনবার বা তার সঙ্গে কথা বলবার কোনও চেষ্টা করেনি। তবু সারাক্ষণ ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল শ্যাম। বিরক্ত হয়ে ভেবেছিল আর কোনওদিন এই হলে আসবে না। কিন্তু এখন এবার সে আধো অন্ধকারে টর্চ-হাতে মানুমামার দিকে সহজ চোখে তাকিয়ে হেসে বলল, কেমন আছ মামু? তারপর কী ভেবে হঠাৎ অনভ্যাসজনিত দ্বিধা ত্যাগ করে নিচু হয়ে মানুমামাকে প্রণাম করল। অন্তত বিশজন লোক এই দৃশ্য দেখল। খুশি হয়ে মানুমামা বলল, তোকে চেনাই যায় না, রোগা হয়ে গেছিস, গালে একগাল দাড়ি, কী হয়েছে? অমায়িক একটু হাসল শ্যাম, তারপর অবলীলায় বলল, গারদ থেকে বেরোলুম। মানুমামা চমকে ওঠে, কী গারদ? শ্যাম আস্তে করে বলে, পাগলা। মানুমামা একটু ইতস্তত করে, চাকরিটা? শ্যাম বলে, গেছে। মানুমামা দরজার দিকে চেয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল, তুই বোস। আমি পরে এসে কথা বলে যাব। শ্যাম বসল, এবং আপনমনে হাসল। মিথ্যেটুকুর জন্য সামান্য ঘেন্না হচ্ছিল তার, তবু কে জানে হয়তো মানুমামা খুশিই হল। আত্মীয়স্বজনদের সে বরাবর এড়িয়ে চলে, তারাও তাকে ঘটায় না। তার কোনও অমঙ্গল ঘটলে এরা কেউ কেউ খুশি হতে পারে। ইন্টারভালের পর হল অন্ধকার হয়ে গেল, সে একসময়ে চমকে উঠে টের পেল তার ডান হাতে কে যেন একটা ভরতি ঠোঙা গুঁজে দিচ্ছে। চেয়ে দেখল মানুমামা, বাদাম-চানাচুরের ঠোঙাটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে সিটের পাশেই প্যাসেজে উবু হয়ে বসে হাসছে। সে তাকাতেই বলল, আমার বড় ছেলে বিশুটাকে একদিন তোর কাছে পাঠাব। ওর সঙ্গে আমাদের বাসায় চলে আসবি। আমাদের গড়িয়ায় মস্ত বড় এক তান্ত্রিক আছে, সব অসুখ সারিয়ে দেন, তোকে দেখিয়ে দেব। শ্যাম মৃদু হেসে বলল, দেখা যাবে। মানুমামা ভূতের মতোই হলের অন্ধকারে নিঃশব্দে মিলিয়ে গেল। শ্যাম গালের দাড়িতে হাত বোলায়। তার জামাকাপড় নোংরা, চোখ ঘোলাটে। কে জানে হয়তো তার দুর্দশা দেখে মানুমামা খুশি হয়নি। কাজেই মানুমামার ভুলটা ভেঙে দেওয়া দরকার মনে করে সে হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে অন্ধকারে আন্দাজে ‘মামুউ’ বলে ডাক দিল। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে তার কাঁধের ওপর একখানা ভারী হাত এসে পড়ল, আস্তে, দাদা! সামান্য হাসির শব্দ। ক্ষীণ অস্পষ্ট একটা গলাও শোনা গেল, মামাকে পরে খুঁজবেন, এখন ছবি দেখুন। শ্যাম আস্তে করে বলল, শালা! তারপর চুপ করে অর্থহীন চোখে ছবি দেখতে লাগল। ভেবে দেখল, এখন মামুর ভুল ভাঙতে গেলে আরও গোলমাল হয়ে যাবে। আরও ভেবে দেখল যে, কয়েকদিনের মধ্যেই তার অনেক আত্মীয়স্বজন জেনে যাবে যে, সে পাগল হয়ে গেছে বা গিয়েছিল। অন্ধকারে আপনমনে নিঃশব্দে হাসল শ্যাম, তারপর সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল।