চেয়ারে অদৃশ্য লোকটা নড়ে ওঠে যেন।
শ্যাম সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত তুলে বলে, না মশাই, আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কিছু বলছি না, একথা সত্যিই যে খেলার জন্যও আপনার মুখে আয়নার আলো ফেলা ঠিক হয়নি…কিন্তু দেখুন, আমারও কিছু করার নেই। বড় অসময় চলছে…সকাল থেকেই দিন লম্বা হতে শুরু করে, সন্ধে থেকেই রাত অফুরান মনে হয়। কিছুই ঘটে না, বস্তুত কিছুই ঘটে না। দিনে দু’বার চিঠির বাক্স খুলি; আমি…পাখির বাসার মতো ছোট্ট চিঠির বাক্স খুলতে গিয়ে প্রতিবার মনে হয় দরজা খুললেই লাফিয়ে পড়বে একটা খরগোশের বাচ্চা, কিংবা হাত দিলেই পাওয়া যাবে গোলাপি কাগজে মোড়া কোনও উপহার, কিংবা অচেনা মেয়ের লেখা ভালবাসার চিঠি। কিছুই ঘটে না, বস্তুত কিছু ঘটে না।…সকালে উঠে মনে হয় আজ কেউ আসবে খুব অচেনা রহস্যময় কেউ—যাকে দেখে মনে হবে চেনা, অথচ চেনা যাবে না, এবং যে যাওয়ার সময় কিছু রহস্য রেখে যাবে; ঘুমোবার সময়ে মনে হয় আজ স্বপ্নের ভিতরে আমি পেয়ে যাব কোনও দৈব শিকড়বাকড়, ক্যানসারের ওষুধ কিংবা গুপ্তধনের সন্ধান; কুয়াশার রাস্তায় হাটবার সময়ে, মনে হয়, কুয়াশা কেটে গেলেই দেখতে পাব আমি হঠাৎ অচেনা বিদেশে পৌঁছে গেছি, যেখানে খাওয়ার লোক নেই বলে ইলিশের ঝক চলে যাচ্ছে সমুদ্রে, গোরুর বাঁট থেকে খসে পড়ছে দুধ, চাক থেকে মধু চুইয়ে মাটি যাচ্ছে ভিজে, যেখানে সৎ ব্যবসায়িরা দোকান সাজিয়ে বসে আছে যেখানে সারা দেশে এক দাম, যেখানে শান্ত ধার্মিক মানুষেরা ধীর পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সারা বছর যেখানে চলেছে উৎসব…
শ্যাম চেয়ারটার সামনে এসে দাঁড়ায়, মাথা নাড়ে–কিছুই ঘটে না! বস্তুত কিছুই ঘটে না।
তারপর শ্যাম বিনীতভাবে অদৃশ্য অনুপস্থিত লোকটাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়, আচ্ছা, আবার দেখা হবে…
ঘরের মাঝখানে আবার ফিরে আসে শ্যাম, বিষণ্ণভাবে চুপ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হঠাৎ ‘ইয়াঃ’ বলে চমকে হেসে ওঠে। সিগারেট ধরিয়ে আবার খবরের কাগজটা তুলে নেয়, গুনগুন করে বলে, মাই গু-উ-উ-নেস, আই কুডনট কিল দ্যা ম্যান।
ঘরের চারি দিকে অন্যমনে চেয়ে দেখে শ্যাম–নাঃ, বস্তুত কোথাও নেই লুকিয়ে থাকবার জায়গা, কিংবা পালিয়ে যাওয়ার সহজ পথ।
.
দুপুরে বেরোনোর সময় শ্যাম তিনটে চিঠি পেল।
জীবনবিমার প্রিমিয়ামের চিঠি, খামের উপর দুহাতে আড়াল করা প্রদীপের ছবি। আপনার জীবন মূল্যবান। ইলেকট্রিকের বিল, আর পাকিস্তানের কালচে খামে বাবার চিঠি। কোনওটাই ভাল করে পড়ে দেখে না শ্যাম। বাবার চিঠির দিকে চেয়ে থাকে, মাঝে মাঝে হঠাৎ এক-আধটা লাইন চোখে পড়ে–সঞ্চয়ি না হইলে ভবিষ্যতে নিরুপায় হইবা…এতদূর হইতে আমরা তোমার জন্য আর কী করিতে পারি, ভরসা একমাত্র দয়াল ঠাকুর…চাকুরীর বন্দোবস্ত হইল কিনা সত্বর জানাইবা…সোনাকাকা ও রাঙাপিসির খোঁজখবর লইও, অভাবের সময়ে আত্মীয়স্বজন…আশু গাঙ্গুলীর সহিত দেখা করিও। সে আমার বাল্যবন্ধু, হাওড়ায় তিনটা লোহার কারখানা, ডোভার লেনে চারিতলা বাড়ি, গাড়ি…জমিজমা আর কিনিতে ভরসা হয় না, অসময় পড়িয়াছে…সময় থাকিতে হিন্দুস্থানে না যাওয়া অবিবেচকের কাজ হইয়াছে…এখানে গঙ্গা নাই, বড় দুঃখ…ধনভাইয়ের শ্রাদ্ধ হইয়া গেল, সমারোহ হয় নাই, হিন্দুস্থান হইতে তাহার ছেলেরা আসিতে পারে নাই, জ্ঞাতিরা মুখাগ্নি করিয়াছে…বড় ভয় হয়…তোমার মায়ের অবস্থা পূর্ববৎ শয্যাশায়ি, পুলিনের বউ আসিয়া রান্নাবান্নার কাজ করিয়া দিয়া যায়…তোমার মা ঘুমের মধ্যেও মাঝে মাঝে তোমার নাম ধরিয়া ডাকেন…ওখানে জিনিসপত্রের দাম…চালের দাম যাহা শুনি, তাহাতে আশ্চর্য হইতে হয়…বাঙালির ছেলে, দু’বেলা ভাত না খাইলে শরীর থাকে না…সাবধানে থাকিও…এখন ঠাকুর ভরসা…তোমাকে সংসারী দেখিয়া যাইতে পারিলে নিশ্চিন্তে চোখ বুজিতাম।
দশ বছর আগে বাবা শেষবার এসেছিল কলকাতায়, শেয়ালদায় আনতে গিয়েছিল শ্যাম। দেখল, যেন একটা অচেনা লোক, একটু কুঁজো, কালো রোগা চেহারা। প্রণাম করতেই পিঠে হাত রেখেছিল বাবা, কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপেছিল, মনু কেমন আছ? যে কয়দিন ছিল, বাবা একটুও স্থির থাকেনি। কাঁচড়াপাড়া, হালিশহর, বৈঁচীগ্রাম, সোদপুর কিংবা ডায়মন্ড হারবার ঘুরে বেড়িয়েছিল আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি। তাকে ডেকে বলত, মনু চিন্যা রাখ। আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্ঠি চিন্যা রাখতে হয়, বিপদে আপদে আপনা রক্তের মানুষ কামে লাগে। এদিকে জমিজমার খোঁজ করেছিল, সম্পত্তি বিনিময়ের চেষ্টাও হয়েছিল একটু, তারপর বলেছিল, আমাগো আর আহন হইব না। ভাল লাগে না রে মনু, এই দ্যাশ বড় রুঠা! পাকিস্তান উঠে যাবে কি না সে খোঁজখবরও একটু নিয়েছিল বাবা। মা পাঠিয়েছিল আমসত্ত্ব, গোকুল পিঠে আর নতুন কাপড়। মাসখানেক পরে বনগাঁয়ের সীমানা পর্যন্ত বাবাকে এগিয়ে দিয়ে এসেছিল শ্যাম। মনু, ভাল থাইকো—এই কথা বলে বাবা এদেশের সীমা ডিঙিয়ে গেল।
এখন, এই যে লোকটা তাকে চিঠি লেখে, তার ভালমন্দের খবর নেয়–এ লোকটা কে! বাবা? কীরকম বাবা। তার মুখ মনে পড়ে না, ভিনদেশি এক অচেনা লোক, ভিটের মায়া ছেড়ে আসতে পারেনি— এ লোকটার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? শ্যামের বাক্সে বাবা-মার একটা জোড়ের ফটো আছে। পিছনে রাজবাড়ির সিন্ ফেলা, পাশে টব, সুতির ডোরাকাটা একটা কোট গায়ে, ধুতি আর পাম্প-৩ পরা গ্রাম্য লোকটা বুক চিতিয়ে বসে আছে, পাশে ধোয়া পাট-ভাঙা জংলা-পেড়ে শাড়ি-পরা মা–জবুথবু, ছোট্ট একটুখানি মানুষ, ক্যামেরার লেনসের দিকে কৌতুহলী চোখ। বিশ্বাস হতে চায় না যে এঁরা শ্যামের মা বাবা, এঁরাই তার জন্মের কারণ। এঁরাও তো জানেন না শ্যাম কে, কিংবা কোথা থেকে এল!