হাইড্র্যান্টের জলে শ্যামের ডান পা ছপ করে গোড়ালি পর্যন্ত ড়ুবে গেল। চোখ চেয়ে হাসল শ্যাম। সামান্য ক্লান্তি লাগছিল তার। অনভ্যাসের বেশি খাবার তার পাকস্থলীতে ডেলা পাকিয়ে উঠছে। তবু ঘরে ফিরতে ইচ্ছে হল না তার। হাঁটতে হাঁটতে সে আবার বড় রাস্তায় চলে এল। চৌরঙ্গির দিকে গেলে মন্দ হয় না, খ্রিসমাস ইভে ওই দিকটাই জমজমাট। বাসস্টপে ঘ্যানঘ্যান করে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটা নানা বয়সের ভিখিরি, কালো চশমাপরা এক মহিলা রুমালে মুখ চেপে চোখ ফিরিয়ে বাসের পথ চেয়ে আছে, রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘টেরিলিন’-পরা দুই হোকরা। বাস এসে গেল। সামান্য ভিড় ঠেলে নামা-ওঠার মধ্যে যে ধাক্কাধাক্কি তাতে গা ছেড়ে দিল শ্যাম। তারপর বাসের হাতল ধরার ঠিক আগের মুহূর্তে পকেটের যাবতীয় খুচরো পয়সা মুঠো করে তুলে ফেলে দিল রাস্তায়। রিনরিন ঠিঠিন সেই শব্দ কয়েক মুহূর্তের জন্য রাস্তার অন্য শব্দকে ড়ুবিয়ে দিল। সেই শব্দের এত জোর যে চমকে উঠল আশপাশের লোকজন, নামতে বা উঠতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল অনেকে। হাসি চেপে শ্যাম দেখল ফুটবোর্ডের ওপর একজন বুড়ো বাসের হাতল ছেড়ে দিয়ে টাল খেতে খেতে ভীষণ সন্দেহে নিজের তিনটে পকেট হাতড়ে দেখছে। পয়সা! আরে! পয়সা পড়ল কার! এরকম একটা চাপা উত্তেজনা তৈরি হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল; ভিড়ের মধ্যে পানকৌড়ির মতো ড়ুব দিল দুটো লোক। শ্যাম নিশ্চিন্তে উঠে গেল বাসে। কন্ডাক্টর ঘন্টির দড়ি টেনে রেখে দিল, তারপর একটু ইতস্তত করে দ্রুত বাজিয়ে দিল ঘণ্টি, চেঁচিয়ে বলল, “ঠিক আছে!’ ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখল শ্যাম, বাস স্টপের ভিখিরিদের মধ্যে ছোটখাটো একটা দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। কিছু লোক জমে গেছে ইতিমধ্যেই। মুখ ফিরিয়ে শ্যাম বাসের ভিতরে ঢুকে যেতে লাগল। তারপর রড ধরে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে ফেলল। সামান্য ভাত-ঘুম পেয়ে বসছিল তাকে।
এলগিন রোড পেরিয়ে সে বসবার জায়গা পেল। থিয়েটার রোডের কাছাকাছি কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলে পকেটে হাত দিয়ে সামান্য থমকে গেল শ্যাম। একটিও খুচরো পয়সা নেই। বুক-পকেটে দুটো দশ টাকার নোট। একটা বাড়িয়ে দিয়ে শ্যাম কন্ডাক্টরের দিকে তাকাল। ঝকড়া চুলওলা কর্কশ চেহারার লোক, মুখে শিরা-উপশিরা জেগে আছে। মাথা ঝাকিয়ে লোকটা বলল, খুচরো দিন। বাসটা একটা স্টপে ধরল! শ্যাম লোকটার চোখে স্থির চোখ রেখে বলল, নেই। কন্ডাক্টর হাতের টিকিটে ‘টিরিক’ করে করে আঙুল দিয়ে শব্দ তুলল, পিছনে তাকিয়ে পার্টনারকে পুরুষ গলায় বলল, বলবে ভাই! তারপর দ্রুত হাতে ঘণ্টির শব্দ তুলে শ্যামের দিকে চেয়ে বলল, খুচরো নেই? শ্যাম মাথা নাড়ে—নেই। আবার সেই হাতের টিকিটে ‘টিরিক’ শব্দ, বিরক্তিতে মাথা ঝাকায় লোকটা, নোটের ভাঙানি হবে না। শ্যাম স্থিরদৃষ্টিতে নোকটার দিকে চেয়ে থেকে বলে, তা হলে? লোকটা অবহেলায় মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, তা হলে আর কী! এমনিই চলুন। বলতে বলতে লোকটা ভিড়ের ভিতর ঢুকে যায়, নেপথ্য থেকে তার গলা শোনা যায়, অনেকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে যে, বাসে বড় নোটের ভাঙানি পাওয়া যায় না। মুহূর্তেই চোখে-মুখে রক্ত ছুটে এল শ্যামের, রাগে আর অপমানে শরীর কেঁপে উঠল তার। ইচ্ছে হল লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে সবাইকে বলে, ভাইসব, একটু আগে গড়িয়াহাটার মোড়ে আমি মুঠো-ভরতি খুচরো পয়সা রাস্তায় ফেলে দিয়ে এসেছি…। কিন্তু বস্তুত তা করল না শ্যাম। শান্তভাবে উঠে দাঁড়াল। কন্ডাক্টর পিছন ফিরে ওদিককার টিকিট নিচ্ছে, শ্যাম তার পিঠে খোঁচা দিয়ে বলল, আমি নেমে যাচ্ছি। লোকটা মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল, একটুও দুঃখিত না হয়ে বলল, আপনার ইচ্ছে। বাসসুদ্ধ লোক দেখছিল শ্যামকে। উকিলের মতো কালো পোশাকপরা বুড়ো একটা লোক শ্যামের রাস্তা আটকে বলল, দাঁড়ান, আমি দেখছি। আমার কাছে থাকতে পারে। বলেই লোকটা হাতের ফোলিও ব্যাগ এগিয়ে দেয় শ্যামের দিকে, এটা ধরুন। আমার ভিতরের পকেটে আছে কি না দেখি। শ্যাম বিনীতভাবে তার ব্যাগটা ধরল হাত বাড়িয়ে। লোকটা চলন্ত বাসে দোল খেতে খেতে তার গলাবন্ধ কোটের তিনটে বোতম খোলে, তারপর রহস্যময় অন্দরমহলে হাত চালিয়ে বের করে আনে একটা প্রকাণ্ড নোটবই। লোকটা পাছে পড়ে যায় সেই ভয়ে শ্যাম লোকটার কাধ চেপে ধরে রাখে, পিছন থেকে একজন দয়ালু হিন্দুস্থানিও লোকটার পিঠে নিজের কাঁধ ঠেকা দেয়। লোকটা তার নোটবই খুলতেই একগাদা খুচরো কাগজ ঝরে পড়ে। আহাঃ’ বলে বুড়ো তখন নিচু হয়ে কাগজ কুড়োয়, শ্যাম আর হিন্দুস্থানিটা তাকে ধরে রাখে। দাঁড়িয়ে এবার সতর্কভাবে অনেক কাগজপত্রের ভিতর থেকে টাকা বের করে লোকটা গুনে-গেঁথে শ্যামের হাতে দেয়। প্রথমে ফোলিও ব্যাগটা, তারপর দশ টাকার নোট তার হাতে দেয় শ্যাম, তারপর একটু কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে, পরোপকার করতে পারায় বুড়োর মুখেও সামান্য হাসি দেখা দেয়। শ্যাম ধীরেসুস্থে ভিড় ঠেলে এগোতে থাকে, পিছন ফিরে আর তাকায় না। কন্ডাক্টরের কর্কশ গলা শোনা যায়, কী হল? ভাড়াটা—?’শ্যাম উত্তর দেয় না। ভাড়া দেওয়ার কোনও ইচ্ছেই সে বোধ করে না। তাই নিজেই ঘন্টির দড়ি টেনে বাস থামায় স্টপে, তারপর নামবার আগে নিজেই ছাড়বার ঘণ্টি দিয়ে দেয়, ময়দানের কাছে নেমে পড়ে। চলন্ত বাস থেকে সামান্য গোলমাল তার কানে আসে, সে কান ফিরিয়ে নেয়। হাসিমুখে মাঠের টলটলে রোদের মধ্যে নেমে যায়।