রাস্তার ভিড়টাকে এড়িয়ে গেল সে। লোকজন জড়ো হচ্ছিল দ্রুত। শ্যাম তাদের পাড়া ছাড়িয়ে গেল। খুব সুন্দর রোদ আজ, তেমন খুব শীতও। খুঁজেপেতে সে একটা নিরিবিলি চায়ের দোকান বের করল। খুবই ওঁছা দোকান। কোণের দিকে একটা জায়গা দখল করে বসে পড়ল। কেন যে মোটরসাইক্লিস্টদের ওপর একটা পোষা রাগ আছে তার— তা ঠিক মনে পড়ছিল না শ্যামের। মনে করতে গিয়ে মাথার ভিতরে ঘোলা জল টলমল করে উঠল। মেঝেয় গড়াচ্ছিল খবরের কাগজ। সে নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিল। অনেক দিন খবরের কাগজ পড়া হয় না। অন্যমনস্ক থাকার জন্যে সে খবরের কাগজে মাথা গুঁজে দিল। দিয়েই দেখল খেলার পাতা। একজন খেলোয়াড় কাল থেকে আটানব্বই রানে নট আউট আছে। বেচারা! সারারাত নিশ্চিত ওর ঘুম হয়নি!কম রানে আউট হয়ে গেলে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারত। তবু আরও দুই রান, মাত্র আর দুটো ভয়ংকর বিভীষিকার মতো রান– বাইশ আর বাইশ চুয়াল্লিশ গজ মাত্র! শ্যামের ইচ্ছে হল লোকটার জন্য এক্ষুনি চুয়াল্লিশ গজ একটা ছুট দিয়ে আসে। অতটুকুর জন্য সারারাত না-ঘুমোনো, খাওয়ার অনিচ্ছা, মহিলার প্রতি শীতল আচরণ–সবই সম্ভব। বেচারা লোকটা! ওই দুটো রান না হলে…! না হলে কী যে হবে ভেবে শ্যাম খুবই অসহায়ভাবে চার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। মনে হল দৈব ছাড়া কোনও উপায় নেই। ওই দুটো রান যে হবেই কোনও মানুষ তা নিশ্চিত করে বলতে পারে না। ভাবতে ভাবতে সামান্য অস্থির বোধ করে শাম। সে খবরের কাগজটা ফেলে দিয়ে উঠে পড়ে। দাম দিয়ে দেয়। তারপর খোলা রাস্তায় রোদ আর বাতাসের মধ্যে এসে দাঁড়ায়। এলোমেলো হেঁটে যায় এ রাস্তা থেকে ও-রাস্তা।
তারপর দুপুরবেলা সে তার পাইস হোটেলে নিজের সম্মানে নিজেকেই একটা ভোজ দিল। মাংসের হাড় ভাঙল মড় মড় করে, দই খেল চেটেপুটে। সুবোধ মিত্র সকাল ন’টায় খেয়ে অফিসে যায়। দেখা হল না। কিন্তু ভেবে রাখল শ্যাম, রাত্রে দেখা হলে মিত্রকে সে খাইয়ে দেবে। আজ মৌরি নিল না শ্যাম, বাইরে এসে দোকান থেকে পান খেল একটা, আর কিনে নিল খুব দামি এক প্যাকেট সিগারেট। ভিখিরিদের দেওয়ার জন্য পুরো একটি আধুলি খুচরো করে নিয়ে পকেটে রাখল। বস্তুত এখন মাসের শেষ, কিন্তু তার কোনও চিন্তাই নেই। ব্যাঙ্কে এখনও আড়াই হাজারের মতো মজুত আছে। ইচ্ছে করলে মাসের যে-কোনও দিনকে মাস পয়লার বিকেলের মতো সুসময় করে তোলা যায়। একত্রিশের জন্মদিনে নিজেকে স্বাধীন বলে মনে হচ্ছিল তার। তার এমনও মনে হচ্ছিল যে, আজকের দিনটা বোধহয় ভালই কেটে যাবে। পরমুহূর্তেই মনে মনে নিজেকে শাসন করল সে। ভবিষ্যৎ-চিন্তাই ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। অতীত চিন্তাও। কাজেই সে সকালের কথা ভুলে গেল, বিকেলের কথাও আর ভাবল না। খর রোদ আর উত্তরে বাতাসের চমৎকার এই দুপুরের মধ্যেই মজে গেল তার মন। খ্রিসমাসের আর দেরি নেই। দোকানে লাল শালুতে লেখা ‘হ্যাপি খ্রিসমাস’। শো কেসে সাজানো কেক, তুলা দিয়ে তৈরি তুষারক্ষেত্র আর বুড়ো সান্টা ক্লস। সামনেই একটা রুটির ভান, পিছনের খোলা দরজা দিয়ে দেখা যায় মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত খোপে খোপে সাজানো রুটি। হঠাৎ মনে হয় পৃথিবীতে বড় সুসময় এসে গেছে। এবার বোধহয় মাঠে মাঠে ফসল ফলেছে খুব, চাষাদের গৃহিণীরা হয়েছে সন্তানবতী। সরকারি বিজ্ঞপ্তি চলে গেছে গ্রামে গ্রামে, আরও সন্তান উৎপাদন করো গো মা-জননীরা। জমিন পতিত রেখো না গো বাপ-সকল, সুসন্তানে ভরে দাও দেশ। আমাদের কারখানায় বাড়ছে উৎপাদন, আমাদের কৃষিতে বাড়ছে উৎপাদন, আমাদের খনিতে বাড়ছে উৎপাদন। এত ভোগ করার লোক কই গো? খাওয়ার লোক নেই বলে আমরা ইলিশের ঝাককে সমুদ্রে চলে যেতে দিলুম, বাছুরে খেয়ে শেষ করতে পারে না বলে আমাদের দুগ্ধবতী গোরুগুলির বাঁট ফুলে দুধ খসে পড়ছে মাটিতে, ভরভরন্ত পাকা ফসলের ক্ষেতে আমরা ছেড়ে দিয়েছি মোষের পাল, আবাদের মৌচাক থেকে চুইয়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মধু। মা-জননীরা লোকজনে ভরে দাও দেশ। সুসন্তান দাও গো, বাপ-সকল! মুখে সামান্য হাসি, গায়ে শীতের স্বাস্থ্যকর রোদ আর ভরা পেটে শ্যাম আস্তে আস্তে হাঁটছিল। অতীতের কোনও মুখ মনে পড়ে না, ভবিষ্যতের কোনও চিন্তা মনে আসে না। বড় তৃপ্ত এবং মিগ্ধ লাগছিল নিজেকে। ফুটপাথে ডাকবাক্সের পিছনে ছেড়া কাথার সংসার থেকে একটা ভিখিরির ছানা হামা দিয়ে ফুটপাথের মাঝামাঝি চলে এসেছে। শ্যাম এক লাফে তাকে ডিঙিয়ে গেল। একজন হকার ধীর-গম্ভীর স্বরে তাকে উদ্দেশ করে হাকল, “গেঞ্জি…! ভীষণ চমকে উঠল শ্যাম। তারপর দ্রুত পেরিয়ে গেল গেঞ্জিওয়ালাকে। আর-একটু হলেই অতীতের কথা মনে পড়ে যেত। সে সামনেই মোড়ের মাথায় বাঁক নিল। ফঁাকা রাস্তা। ঢিমেতালে ক্লান্ত একটি লোক ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। শ্যাম টপ করে চোখ বুজে ফেলে। অমনি চোখের ওপর ছবি ফুটে ওঠে। সারি সারি সব দোকান, সৎ দোকানিরা পবিত্র চোখ নিয়ে বসে আছে। শালীন ও সুন্দরী যুবতীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়, শান্ত ও সুন্দর শিশুরা হেঁটে যাচ্ছে, নির্লোভ, বিনয়ি ও স্বাস্থ্যবান যুবা পুরুষ দ্রুত চলেছে কাজে, কর্মঠ ও বিজ্ঞ বুড়োরা সকৌতুক চোখে বারান্দায় বা ব্যালকনিতে বসে কাটিয়ে দিচ্ছে সুন্দর অবসরের জীবন। সর্বত্রই অদৃশ্য বিজ্ঞাপন বেঁচে থাকুন। আপনার জীবন আমাদের কাছে মূল্যবান।