অমলেশ স্কুলের ভাল ছাত্র। কিন্তু শুধুই ভাল ছাত্র। তার সারাক্ষণের সঙ্গী। কেবল বই। সে ফুটবল মাঠের পাশ দিয়ে নির্বিকার হেঁটে চলে যেত, একবার ফিরেও তাকাত না খেলার দিকে। সে সিনেমা দেখত না, আড্ডা মারত না, শুধু দেদার নম্বর পেয়ে ফাস্ট হয়ে এক ক্লাস থেকে আর এক ক্লাসে উঠত। সবাই বলত, গুড বয়। ভেরি গুড বয়।
আমি ছোটোবেলা থেকে তাকে দেখে আসছি। একইরকম পোশাক। একইরকম আঁচড়ানো চুল। কোনওদিন ফুলহাতা শার্টের হাতদুটো গুটিয়ে পরতে দেখিনি তাকে।
আমি তখন খুবই ছোটো, ছ সাত বা আট বছর বয়স, তখন অমলেশ এইট নাইনের ছাত্র। বয়সের তুলনায় খুব গম্ভীর। সে কারও বাড়িতে যেত না। তবে তার দুটো বোন আর একটা ছোট ভাই আমাদের বাড়িতে বহুবার সত্যনারায়ণ পুজোর সিন্নি বা হরির লুটের বাতাসা খেয়ে গেছে। আমাদের পুরোনো জামাকাপড় মা তাদের দিয়ে দিত, তারা সেসব পরে দিব্যি বেড়াত। শুধু অমলেশদাই ছিল অন্যরকম। যেন কারও সঙ্গেই তার কোনও সম্পর্ক নেই। এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ উদাস ও পথভ্রষ্ট হয়ে সে এসে পড়েছে।
মনে আছে, একদিন অমলেশদা যাচ্ছে, পাড়ার ছেলেরা টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলছে রাস্তার পাশে। কাদামাখা সেই বলটা হঠাৎ দুম করে এসে অমলেশদার সাদা জামার বুকে লাগল। অন্য কেউ হলে দাঁড়াত, বিরক্ত হত, একটু বকাঝকাও করত। কিন্তু অমলেশদা এক সেকেন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে জামায় বলের দাগটা মাথা নিচু করে একবার দেখল। তারপর চুপচাপ চলে গেল।
অমলেশদা যেবার স্কুলের শেষ পরীক্ষায় গোটা পশ্চিম বাংলায় নাইনথ স্ট্যান্ড করে পাশ করল তখনও আমি ফ্রক পরি। অমলেশদার মা এসে আমার মাকে বললেন, কলকাতার বড় কলেজে পড়তে ডাকছে অমলকে। তা সে কি আর আমাদের কপালে হবে! অত খরচ।
গোটা শহরে খবরটা নিয়ে বেশ হৈ-চৈ হল। এই ছোট শহর থেকে কেউ সচরাচর এমন কৃতিত্বের পরিচয় দেয় না। স্কুলে আর টাউন হলে দুটো সভা হল অমলেশদাকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য। টাউনহলের সভায় আমি আর দুজন মেয়ের সঙ্গে উদ্বোধনী সংগীত গেয়েছিলাম। অমলেশদার কপালে চন্দনের ফোঁটা পরানো আর গলায় মালা দেওয়ার ভার পড়ল আমার ওপর। অমলেশদার কপালে ফোঁটা দিতে অনেকটা ঝুঁকতে হয়েছিল। লজ্জায় মাথা নত করে ছিল অমলেশদা। মালাটা গলায় দিতে না দিতেই খুলে পাশে সরিয়ে রাখল। মুখে চোখে কৃতিত্বের কোনও দীপ্তি বা অহংকার নেই। যেন নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে পারলে বাঁচে।
অমলেশদার কলকাতার কলেজে পড়তে যাওয়া হল না। এ শহরের কলেজেই ভর্তি হল। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যেত আগের মতো। পরিবর্তনের মধ্যে একটু লম্বা হল, সামান্য গোঁফ দাড়ির আভাস দেখা দিল। পরের পরীক্ষায় আবার দারুণ রেজাল্ট। শহরে আবার হৈ-চৈ।
অমলেশদার বোন সুমিতাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতাম, হ্যাঁ রে, অমলেশদা বই ছাড়া আর বুঝি কিছু চেনে না?
না। ওর শুধু বই।
তোদের সঙ্গে গল্প করে না?
খুব কম। যা ভয় পাই দাদাকে! যখন আমাদের পড়ায় তখন সারাক্ষণ বুক দুরদুর করে।
খুব বকে বুঝি?
না না, একদম বকে না। কিন্তু এমন করে ঠাণ্ডা চোখে তাকায় যে তাতেই আমাদের হয়ে যায়। ভীষণ কম কথা বলে তো। যা কথা সব মায়ের সঙ্গে।
অমলেশদা সম্পর্কে আমার কেন জানি না, খুব জানতে ইচ্ছে করত। গম্ভীর লোকটা আসলে কেমন, রাগী না রসকষ আছে, কাঠের পুতুল না রক্তমাংসের মানুষ। কিন্তু ওদের বাড়িতে যাওয়া আমাদের বিশেষ হয়ে উঠত না। ওদের ঘরে বসবার জায়গা নেই। কেউ গেলে ওরা এমন ছোটাছুটি করত, দোকানে যেত ধারে মিষ্টি আনতে বা চায়ের চিনি জোগাড় করতে যে আমাদের অস্বস্তিতে পড়তে হত। হতদরিদ্র বলেই বোধহয় অতিথি এলে ওরা আপ্যায়ন করার জন্য অস্থির হয়ে পড়ত। এ জন্য মা বলত, যাওয়ার দরকার কী?
অমলেশদার তিন ভাই বোন অমিতা, সুমিতা, অলকেশ সবাই নিজের নিজের ক্লাসের ফাস্ট গার্ল বা বয়। কিন্তু কেউ অমলেশদার মতো মুখচোরা আর বই-সর্বস্ব নয়। অলকেশ ভাল ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন খেলত। সুমিতা আর অমিতা গান গাইত, সেলাই ফোঁড়াই করত।
তখন আমার বয়ঃসন্ধি উঁকি ঝুঁকি মারছে। আনচান করে মন, শরীর। প্রথম ঋতুদর্শন বয়ে আনল ভয় ও শিহরণ। জীবনের অজানা সব জানালা দরজা হাট করে খুলে দিল কে। শরীরে লজ্জাজনক নানারকম পরিবর্তন ঘটে যায়, বদলে যায় বাইরের পৃথিবীও।
সেই সময়ে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বোকার মতো কাজটা করে ফেলি। সেই লজ্জা আজও আমাকে কুঁকড়ে রাখে। আমি অমলেশদাকে একটা চিঠি দিই। চিঠিতে তেমন দোষেরও কিছুই ছিল না। শুধু লিখেছিলাম, আমি আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই। আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে।
চিঠির কোনও জবাব এল না।
আমি মাকে ধরলাম, মা, অমলেশদাকে বলো না আমাকে পড়াতে। অত ভাল ছাত্র।
মা আপত্তি করল না। কিন্তু খোঁজ নিয়ে বলল, না, ও টিউশনি করে না। খুব লাজুক ছেলে তো।
ব্যাপারটা সেখানেই মিটে যেতে পারত। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, অমলেশদা আমার চিঠি পায়নি।
কিন্তু তা নয়। একদিন সুমিতা আমাকে এসে বলল, হ্যাঁরে, কী অদ্ভুত কাণ্ড! দাদা কাল তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল আমাকে।
আমি ভীষণ চমকে উঠলাম, কী কথা?
জিজ্ঞেস করছিল তুই কে, কোন বাড়ির মেয়ে, এইসব।
বুকের মধ্যে কেমন করছিল আমার। ভয়, অনিশ্চয়তা, শিহরন। আমার চিঠির কথা অমলেশদা বলে দেয়নি তো ওকে? গলা প্রায় বুজে আসছিল। জিজ্ঞেস করলাম, আর কী বলছিল?