প্রীতির সঙ্গে কথা বলে সুখ নেই। কোনও না কোনওভাবে ও ওর নীতীশের কথা এনে ফেলবেই। নীতীশ ওর হবু বর। পাঁচ বছর ধরে প্রেম করার পর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এখন ওর মুখে কেবল নীতীশ আর নীতীশ। নীতীশ ওকে একটা সেন্ট দিয়েছে, বিয়ের পর নীতীশ ওকে কাশ্মীর নিয়ে যাবে, নীতীশ চাকরিতে একটা প্রমোশন পেয়ে ওকে বলেছে, তুমি ভীষণ পয়া… এইসব। ওর নীতীশকে আমরা ভালই চিনি। এমন কিছু নয়। কিন্তু ও এমন বলবে যেন নীতীশের মতো আর কেউ হয় না।
পুরুষ মানুষদের মেয়েরা কি পছন্দ করে? এ কথাটার জবাব কোনও মেয়ে কি দিতে পারে? যদিও কলেজের মেয়েরা আলাদা করে বনভোজন করি, কিন্তু আমাদের কলেজটা কো-এডুকেশন। একবার বনভোজনে ছেলেরা খুব অসভ্যতা করেছিল বলে এখন আর একসঙ্গে পিকনিক হয় না। ছেলেদের হ্যাংলামির জন্য বনভোজনের আনন্দটাই মাটি হয়ে যায়। শুধু বনভোজন, রোজ কলেজেই কি কিছু কম ব্যাপার হয়? মেয়েদের নজরে পড়ার জন্য, হীরো হওয়ার জন্য ছেলেরা কত কীই না করে! কেউ কেউ তো পাউডার মেখেও আসে। যার স্বাস্থ্য ভাল সে মাসল ফুলিয়ে বেড়ায়। মেয়েদের কমনরুমে আমরা সেসব নিয়ে হেসে গড়াই।
নীতীশের কথা ফেঁদে বসার জন্য প্রীতি উসখুস করছিল। হঠাৎ বলল, জানিস বসন,…।
আমি বুঝলাম এবার নীতীশের কথা আসছে।
আমি দুম করে জিজ্ঞেস করলাম, তোদের বিয়ে কবে যেন!
প্রীতি বলল, বিয়ে! সে বৈশাখের আগে নয়। আষাঢ়ও হতে পারে। ওর তো ছুটিই নেই। প্রমোশন পাওয়ার পর যা কাজ বেড়েছে। আর ওকে ছাড়া অফিস অন্ধকার। ম্যানেজার তো বলেইছে, নীতীশ, তুমি না থাকলে অফিস অচল।
বিয়ের পরও কি তুই পড়াশুনো চালিয়ে যাবি?
ও মা, চালিয়ে যাব না! আমার শ্বশুর আর শাশুড়ি তো বলেই দিয়েছে, বউমা, যত পারো কোয়ালিফিকেশন বাড়াও। সংসারের কিছুই তোমাকে করতে হবে না। শেখো, জানো, বড় হও।
আমার খুব হাসি পেল। প্রীতি খুব সাধারণ ছাত্রী। ওর কোয়ালিফিকেশন খুব বেশি বাড়বার কথা নয়। আর প্রীতি হল সংসারী টাইপের। বিয়ের পরই ও এমন মজে যাবে সংসারে যে, পড়াশুনোর কথা ওর মনেই পড়বে না।
প্রীতি তার নীতীশের কথা শুরু করে দিল। আমি চারদিকে জ্যোৎস্নার অপার্থিব আলোয় কোন অচেনা জগতে চলে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে প্রীতির ছেঁড়া ছেঁড়া কথা কানে আসছিল, নীতীশকে তো জানিস, কেমন অনেস্ট আর আপরাইট… ও তো বলে, তুমি আমার গাইডিং কোর্স… ওরা কিচ্ছু চায় না রে, এমন কী ঘড়ি-আংটি অবধি নেবে না বলেছে… টাকাপয়সা একদম চেনে না নীতীশ, সব আমাকে সামলাতে হবে…
কোনও পুরুষের প্রতি আমার কেন এরকম আকর্ষণ নেই?
আজ যখন আমরা এক দঙ্গল মেয়ে পিকনিকে আসছিলাম, তখন একটা জিপ গাড়িতে কয়েকটা অবাঙালি ছেলে অনেক দূর পর্যন্ত আমাদের পিছু নিয়েছিল। দিদিমণিরা বারণ করলেন, যেন আমরা ওদের দিকে না তাকাই। ছেলেগুলো শিস দিয়ে, হিন্দি গান গেয়ে, হাতের মুদ্রায় অনেক ইশারা ইঙ্গিত করেছে। মেয়েরা সবাই তাই দেখে কী হাসাহাসি, ঢলাঢলি! শুধু আমারই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল।
আমার পিসতুতো দাদার কলিগ এক ইনজিনিয়ার সবে এ শহরে এসেছে বদলি হয়ে। কয়েকদিনের মাত্র পরিচয়। মাসখানেক আগে লোকটা এক সন্ধেবেলায় আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ফ্রি আছেন?
ছেলেদের হাড়ে হাড়ে চিনি। গলার স্বর শুনেই বুঝলাম, হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। বেশ কড়া গলায় বললাম, তার মানে?
লোকটা বেশ স্মার্ট। একটু হেসে বলল, মানে এগোনো যাবে কিনা। কোনও চান্স দেবেন কি?
আমি বললাম, আমি ফ্রি আছি, আর এরকমই থাকতে চাই।
স্মার্ট লোকটা ঘাবড়াল না। অপমানটা হজম করে বলল, থ্যাংক ইউ।
সেইখানেই সম্পর্কটা শেষ।
পর্যায়ক্রমে দুজন অধ্যাপক এবং একজন ডাক্তারও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। সরাসরি আমাকে নয়, আমার বাবার মারফত। আমার বাবা বলেছেন, মেয়েকে বলে দেখি।
আমি নাকচ করে দিয়েছি।
পুরুষ জাতটাকে যে আমি কেন বিশ্বাস করতে পারি না তা আমার আজও বুঝে ওঠা হল না।
আমি পাথর থেকে নেমে পড়ে বললাম, একটু ঘুরি। বসে থেকে ভাল লাগছে না।
এবার আমি দলছুট। একা। ওরা কেউ এল না।
দিদিমণিদের একজন মণিকাদির সরু গলা পাচ্ছি, মেয়েরা, তোমরা চলে এসো। লরিওলা আর দেরি করতে রাজি নয়। রাত দশটা অবধি কন্ট্রাক্ট।
জানি, সবকিছুরই একটা বাধ্যবাধকতা আছে। এই যে মুক্তি, ছুটি, জ্যোৎস্নায় অপরূপ প্রকৃতির মধ্যে স্বপ্নময় পদচারণা এ থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। তেমনি একদিন সিঁথিমৌর পরে, গয়নায় শাড়িতে চন্দনের ফোঁটায় সেজে বসতে হবে বিয়ের পিড়িতে।
নারী ও পুরুষ নাকি পরস্পরের পরিপূরক। আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয়, পুরুষকে ছাড়াই আমার চলে যাবে।
হাঁটতে হাঁটতে আমি অনেকটা দূর চলে আসি। নিঃসঙ্গতাই আমার হাত ধরে থাকে। পাশাপাশি হাঁটে আমার সঙ্গে। নিঃসঙ্গতাই আমার প্রিয় বন্ধু।
আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই স্কুলে যেত অমলেশ। লম্বা রোগা চেহারা, জামার বোতাম গলা অবধি আটকানো, পরনে মোটা ধুতি, মাথায় চুল পাট করে আঁচড়াননা। কোনওদিকে তাকাত না, সোজা হেঁটে যেত। আমাদের তিনটে বাড়ির তফাতে তার বাড়ি। টিনের চাল আর বাঁশের বেড়ার ঘর। তার বাবা মাইনর স্কুলের মাস্টারমশাই। কখনও জামা গায়ে দিতেন না, খালি গায়ে একটা উড়নি জড়িয়ে সর্বত্র যেতেন। অমলেশের মা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি আসতেন চাল, তেল, নুন বা চিনি ধার করতে। তাঁর মুখেই শুনতাম অমলেশ প্রায়ই না-খেয়ে স্কুলে যায়, কারণ ঘরে চাল বাড়ন্ত হয় মাঝে মাঝে। তিনি দুঃখ করে বলতেন, ছেলেটা লেখাপড়ায় ভাল, কিন্তু তেমন করে খেতে দিতে পারি কই! কচুঘেঁচু খেয়ে আর কতদূর কী করবে?