দুপুরবেলা পুলিশ এসে সকলের জবানবন্দী নিচ্ছিল। তাদের জেরার মুখে পড়ে ভজহরি কী একটা বলতে যাচ্ছিল আমতা আমতা করে। কিন্তু কেন যেন হঠাৎ ফ্যাকাসে মুখে চুপ করে গেল। সন্দেহবশে পুলিশ নন্দ ঘোষাল আর ভজহরিকে ধরে নিয়ে গেল।
আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, জ্যাঠাশ্বশুর ভাসুর আর স্বামী চুরি-যাওয়া গয়না নিয়ে নানারকম আলোচনা গবেষণা করতে লাগলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, পিসিমার গয়নার ওপর এ পরিবারের একটা প্রত্যাশা ছিল। হয়তো বা এ পরিবারের নিঃশেষিত সোনাদানার ভাণ্ডারে ওই গয়না কিছু প্রাণ সঞ্চার করতে পারত। পুরুষেরা সোনা বেচে আরও কিছুদিন পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে বসে খেতেন।
আমি গরিব ঘরের মেয়ে। একশ ভরি সোনা আমার স্বপ্নেরও অগোচর। এই সোনার ভার আমি বইব কী করে? কয়েকটা দিন আমার অস্থিরতা এমন বাড়ল যে, পাগল-পাগল লাগত। কী করব বুঝতে পারি না। গোপন কথার একজন ভাগীদার থাকলে বেশ হয়। কিন্তু আমার গোপন কথাটাও এতই বিপজ্জনক যে কাউকে বলতে সাহস হয় না।
নন্দ ঘোষাল না থাকায় আমাকেই রান্না করতে হয়। জা অসুস্থ, ঘর থেকে বেরোন না। শাশুড়ির বয়স হয়েছে। কাজের লোকও পাওয়া যাচ্ছে না। রাঁধতে পেরে আমি বেঁচেছি। একটা কাজ তো! কিছুক্ষণ সময় কাটে, অন্যমনস্ক থাকা যায়।
একদিন সন্ধেবেলা কষে মাংস রাঁধছি! আমার রান্নার হাত ভাল। যে খায় সেই প্রশংসা করে। গরম মশলা থেঁতো করতে শিল পাটা পেতেছি, এমন সময় দেখি, কপাটের আড়াল থেকে সাদা থান একটু বেরিয়ে আছে। কে যেন কপাটের আড়ালে দাঁড়ানো। এ বাড়িতে বিধবা তো কেউ নেই! আমি হিম হয়ে গেলাম ভয়ে। হাত পা কাঠ।
আড়াল থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এল। পিসিমার নির্ভুল গলা শুনতে পেলাম। একটু চাপা, মাংস রাঁধছিস?
বুক ধড়ধড় করছে। তবু অভিজ্ঞতাটা একেবারে নতুন নয় বলে কোনও রকমে বললাম, হাঁ।
বেশ গন্ধটা বেরিয়েছে তো!
আমি চুপ করে বসে রইলাম।
কতকাল খাইনি। স্বাদই ভুলে গেছি। ভাল রাঁধিস বুঝি?
কী জানি! কাঁপা গলায় বললাম।
বেশ হবে খেতে। কিন্তু নুন দিতে ভুলে গেছিস যে! ভাল করে নুন দে।
থানটা সরে গেল। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে শোওয়ার ঘরে পালানোর একটা ইচ্ছে আমার হয়েছিল। কিন্তু জোর করে নিজেকে শক্ত রাখলাম। কারণ, এই ভবিতব্য নিয়েই বোধহয় আমাকে বাঁচতে হবে। মাংসে নুন দিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল, একবার যেন দিয়েছি আগে।
সেই রাতে প্রত্যেকেই খেতে গিয়ে বলল, মাংসটা খুবই ভাল রান্না হয়েছিল, কিন্তু নুন বড্ড বেশি হয়ে গেছে। কেউ খেতে পারল না। এত রাগ হল!
রাতে আমি আমার স্বামীকে বললাম, আচ্ছা আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?
উনি কেমন যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না তো! কেন?
ও কিছু নয়।
২. বসন
॥ বসন ॥
বনভোজনের পর সন্ধেবেলা মস্ত চাঁদ উঠল পাহাড়ের মাথায়। এত বড় চাঁদ আমরা কেউ কখনও দেখিনি। চারদিকে পাহাড়, জঙ্গল, নদী, নুড়িপাথর আর বালিয়াড়ি সব যেন রূপকথায় ডুব দিয়ে নতুন রূপ ধরে ভেসে উঠল। কী সুন্দর যে হল সন্ধেটা! আমাদের অনেকের গলায় গুনগুন করে উঠল গান। প্রথমে গুনগুন, তারপর জোরে, তারপর চেঁচিয়ে কোরাস।
লরিতে আমাদের ডেগ, কড়াই, হাতখুন্তি তোলা হচ্ছে। রান্নার লোক আর যোগালিরা ওসব কাজ করছে। এখনও ফিরতে একটু দেরি আছে আমাদের। আমরা মেয়েরা হাত ধরাধরি করে গান গাইতে গাইতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিলাম।
দিদিমণিরা চেঁচিয়ে বলছিলেন, বেশি দূর যেও না তোমরা। আর আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা রওনা হব।
কে কার কথা শোনে! এই সন্ধেটা কি আর ফিরবে? এমন জ্যোৎস্না, এমন চমৎকার জায়গা ছেড়ে কে গিয়ে ঘুপচির মধ্যে ঢুকতে চায় বাবা?
একসঙ্গে সকলের থাকা হয় না। বড় দল ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যায়। এটাই নিয়ম। আমরাও ভাগ হয়ে ভাগে পড়লাম চারজন। পাহাড়ি নদীর ধার দিয়ে দিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেলাম আমরা। দিনের বেলাতেও হেঁটেছি। কিন্তু তখন জ্যোৎস্না ছিল না, জলে ছিল না চাঁদের ছায়া, তখন ছিল এমন রূপকথার মতো জগৎ।
বড় বড় পাথরের টুকরো নদীর মধ্যে ছড়ানো। একটা ছিপছিপে নদী কত পাহাড় ভেঙে পাথর বয়ে এনেছে এই অবধি। এখন শীতের টানে তত স্রোত নেই। কী ঠাণ্ডা আর স্ফটিকের মতো পরিষ্কার জল!
আমরা চারজন দুটো পাথরের ওপর ভাগ হয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ গলা মিলিয়ে গাইলাম আমরা, চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে… ও চাঁদ চোখের জলে… চাঁদ নিয়ে আর গান মনে পড়ছিল না। গলা মিলছে না, গানের কথা ভুল হচ্ছে। আমরা ‘ধ্যাত্তেরি’ বলে হেসে উঠলাম।
আমার পাশে প্রীতি। অন্য পাথরটায় সুপ্রিয়া আর সীমন্তিনী। বসে বসে আমরা বকবক করতে লাগলাম।
খুব শীত। থম ধরে থাকা শীত তবু সহ্য করা যায়। কিন্তু উত্তুরে হাওয়া দিলে হাড় অবধি কাঁপিয়ে দেয়। সন্ধের পর সেই হিমেল হাওয়াটা ছেড়েছে। কার্ডিগান আর স্কার্ফ ভেদ করে হাওয়া আমাদের ঝাঁঝরা করে ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভিতরে। আমি তো পেটের মধ্যে অবধি ঠাণ্ডা টের পাচ্ছিলাম। আজ রাতেই আমার সর্দি হবে। নাক সুরসুর করছে। জ্বরও হতে পারে। হোক গে। কী ভাল লাগছে বসে থাকতে!
নিজেদের অজান্তেই আমরা চারজন আবার দুজন দুজন করে ভাগ হয়েছি। কথা হচ্ছিল চারজনের সঙ্গে চারজনের। এখন হচ্ছে প্রীতিতে আমাতে। সুপ্রিয়া আর সীমন্তিনীতে।