দুপুরটা এইভাবেই কেটে গেল।
বিকেল হল। স্বামী উঠলেন। আমি রান্নাঘরে তাঁর জন্য চা করতে গেছি, ঠিক এ সময়ে শুনতে পেলাম, দোতলার সিঁড়িতে দৌড় পায়ের আওয়াজ আর একটা চেঁচামেচি। আমার ভাসুর আমার স্বামীকে ডাকছেন। স্বামীও দৌড়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর ভজহরি বেরিয়ে ডাক্তার ভদ্রকে নিয়ে এল।
আমি চুপ করে সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ভজহরি নীচে নেমে আসছিল, আমাকে দেখে বলল, বউদি! সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড। বড় বউদির জপ বন্ধ হয়ে গেছে।
জপ বন্ধ! তার মানে কী?
কথা বন্ধ হয়ে গেছে। কিছুই বলতে পারছেন না। শুধু আঙুল তুলে কাকে দেখাচ্ছেন আর উঁ উঁ করছেন।
আমি একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লাম। কিন্তু আঙুল তুলে জা কাকে দেখাচ্ছেন?
বিকেলে কেউ বাড়ি থেকে বেরলেন না আজ। সকলের মুখ গম্ভীর। কাল এ বাড়িতে একটা মৃত্যু আর আজ একজনের কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই একটু বিহুল।
স্বামী এসে বললেন, লতা, তুমি একটু বউদিকে দেখে আসবে নাকি? কেন যে হঠাৎ কথা বন্ধ হয়ে গেল!
আমি মৃদুস্বরে বললাম, উনি আমাকে পছন্দ করেন না। তবে আপনি বললে যাব।
আমি দোতলায় উঠে তাঁর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই আমার জা শোয়া অবস্থা থেকে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বসে পড়লেন, তারপর আমার দিকে আঙুল তুলে উঁ উঁ করে শব্দ করতে লাগলেন। বুঝলাম উনি গয়নার বাক্সের চোরকে চিনিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু সেটা কেউ বুঝতে পারছে না।
আমার ভাসুর চাতক মিত্র চমৎকার মানুষ। ইনি আমার স্বামীর চেয়েও বোধহয় সুপুরুষ। সুন্দর মুখখানায় দুশ্চিন্তা আর ভয়ের ছাপ পড়েছে। আমার দিকে চেয়ে অসহায়ভাবে বললেন, কী হল বলল তো বউমা? ও এরকম করছে কেন?
আমি মৃদুস্বরে বললাম, হয়তো কিছু একটা বলতে চাইছেন।
কী বলতে চাইছে? তুমি বুঝতে পারছো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। তবে উনি ভাল হয়ে উঠলে হয়তো বলতে পারবেন।
ডাক্তারও বুঝতে পারছেন না হঠাৎ কেন এরকম হল। জিবটা অসাড় হয়ে গেছে। সমস্ত শরীরের মধ্যে কারও শুধু জিবটা অসাড় হয়ে যায় এরকম কখনও শুনিনি।
আমার জা বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখছেন আর স্বামীর দিকে ফিরে আমাকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন। আমি একটু একটু ভয় পাচ্ছিলাম।
আমার ভাসুর বড় নিরীহ শান্ত মানুষ। দাপুটে স্ত্রীর সামনে তিনি যেন সবসময়ে মিইয়ে থাকেন। ঘর থেকে বড় একটা বেরোন না। সন্ধের পর একটু আধটু আড্ডা মারতে যান। এ বাড়ির বেশিরভাগ পুরুষই নিষ্কর্মা, দিবানিদ্ৰাপরায়ণ, অলস মস্তিষ্ক। এঁরা বিপদে পড়লে ভীষণ ঘাবড়ে যান। অনভ্যাসে এঁদের বুদ্ধিসুদ্ধিরও তেমন ধার নেই। স্ত্রীর অসুখে আমার ভাসুর এতই ঘাবড়ে গেছেন যে, জায়ের ইঙ্গিত বা ইশারা বুঝতেই পারলেন না।
কিন্তু মুখ বন্ধ হলেও কথা বলার অন্য উপায় আছে। আমার জা তো কাগজে লিখেই সব তাঁর স্বামীকে জানাতে পারেন। হয়তো জিব আচমকা অসাড় হয়ে যাওয়ায় উত্তেজিত মাথায় বুদ্ধিটা খেলছে না। কিন্তু কিছু পরেই নিশ্চয়ই কথাটা খেয়াল হবে। তখন আমার বিপদ আছে।
হঠাৎ আমার ভাসুর টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা দেখো। কিছু বুঝতে পারছো?
একসারসাইজ খাতার একটা রুলটানা পাতা। তাতে একটা অক্ষর লেখা গ। আর তারপর থেকে সব হিজিবিজি আঁকিবুকি।
আমার ভাসুর বললেন, ও একটা কোনও জরুরি কথা বলতে চাইছে। লিখতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। শুধু গ অক্ষরটা পড়া যাচ্ছে।
উনি বুঝতে না পারলেও ওই গ অক্ষরটা আমি খুব বুঝতে পারছি। বললাম, ওঁর হাতও কি অসাড়?
না তো? হাতে তো কিছু হয়নি। কিন্তু লিখতে পারছে না।
আমি মুখে দুঃখের ভাব ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুঃখ যে আমার হচ্ছিল না তাও নয়। আসলে দুঃখের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে আমার ভয়। এসব কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে তা আমি জানি না। কিন্তু হচ্ছে।
আমার ভাসুর বললেন, তুমি একটু ওর কাছে বসে থাকো। আমি ওষুধ কিনে আনতে যাচ্ছি।
ভাসুরের এ কথায় আমার জা যেন হঠাৎ ভয়ঙ্কর ভীত আর উত্তেজিত হয়ে উঁ উঁ উঁ উঁ করতে লাগলেন। মনে হল, উনি ভাসুরকে যেতে বারণ করছেন। ভাসুর ওঁর দিকে চেয়ে বললেন, কোনও চিন্তা নেই, লতা আছে। আমি এখনও আসছি।
ভাসুর বেরিয়ে গেলেন।
উনি বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি আমার জায়ের মুখে যে আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখলাম সেরকম দৃশ্য আমি জীবনে দেখিনি। ওঁর চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে পড়ল, মুখ হাঁ, ঘন ঘন শ্বাস। আমি তাড়াতাড়ি ওঁর কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, ওরকম করছেন কেন দিদি? সব ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের কিচ্ছু নেই।
উনি যেন ভয়ে গুটলি পাকিয়ে গেলেন। পিছু হটে খাটের রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে হঠাৎ আর্তস্বরে বলে উঠলেন, আমাকে মেরো না! আমাকে মেরো গয়নার কথা আমি কাউকে বলব না। কালীর দিব্যি! আমি ওর ভাগ চাই তুমি মন্ত্রতন্ত্র জানো, বাণ মেরে আমার জিব: অসাড় করে দিয়েছে। আমি এই কান মলছি, নাক মলছি, কখনও যদি আর কিছু বলি! তোমার পায়ে পড়ি। আমাকে ছেড়ে দাও..
বোবার মুখে কথা ফুটতে দেখে আমার বুদ্ধি আবার গুলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে বিহ্বল চোখে চেয়ে রইলাম। জা হাউ হাউ করে কাঁদছেন। আমার দিকে হাতজোড় করে চেয়ে আছেন। হাত দুখানা থরথর করে কাঁপছে। মুখ ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে আর লালায়। এত কষ্ট হচ্ছিল! আমি ঠিকে ঝি পরেশের মাকে ডেকে ওঁর কাছে থাকতে বলে ঘরে চলে এলাম।