তা নিয়ে অন্যরা মাথা ঘামাক। আমার মনে হয় পিসিমার গয়নার সঙ্গে তাঁর আত্মার দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকবে। আমাদের ও গয়নার দরকার নেই।
আমার স্বামী এ কথাটাও যেন মেনে নিলেন। তারপর বললেন, মা বলছেন তিনতলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে আমরা যেন ওপরে চলে যাই।
আমি চমকে উঠে বললাম, কেন? আমরা তো এখানে বেশ আছি।
কোথায় বেশ আছি? নীচের তলাটা অন্ধকার, মশামাছির উৎপাতও বেশি। তিনতলায় কত আলোবাতাস। জায়গাও অনেক বেশি। তিনতলায় দাদা-বউদি যাবে না। বাবার হার্ট ভাল নয় বলে মা-বারাও একতলা ছাড়বেন না। জ্যাঠামশাই একা মানুষ, তাঁরও দরকার নেই। আমরা না গেলে ওটা ফাঁকা পড়ে থাকবে।
থাকুক। ওখানে থাকতে আমার ভয় করবে।
আমার স্বামী হাসলেন। হাসলে তাঁকে খুবই সুন্দর দেখায়। আমি তাঁর মুখের দিকে খানিকক্ষণ মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকলাম। তিনি বললেন, মৃত মানুষের কিছুই তো থাকে না। তবে ভয় কিসের?
আমি বললাম, আপনি আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। তবে আমার মনে হয় মানুষ মরে গেলেও তার কিছু ভাব থেকে যায়। আপনি আমাকে তিনতলায় থাকতে বলবেন না।
স্বামী দুঃখিতস্বরে বললেন, কিন্তু পিসিমা মারা গেলে তিনতলায় গিয়ে থাকব এ ইচ্ছে যে আমার বহুদিনের।
আমি করুণ কান্না-ভেজা গলায় বললাম, কিন্তু আমাদের তো এখানেই বেশ চলে যাচ্ছে। তাই না, বলুন!
উনি আর জোর করলেন না।
বাড়িতে ওদিকে গয়নার বাক্স নিয়ে তুমুল একটা আলোচনা আর তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে। তাতে আমি আমার জায়ের গলা না পেয়ে একটু চিন্তিত হলাম। আমার জ্যাঠাশ্বশুর পুলিশে যাওয়ার কথাও বললেন।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আমার জা ভজহরিকে দিয়ে আমাকে ছাদে ডেকে পাঠালেন। সেটা হেমন্তকাল, কিন্তু ছাদে খুব রোদ ছিল তা মনে আছে।
জা আমার দিকে সোজা চোখে চেয়ে বললেন, গয়নাগুলো পাচার করে দাওনি তো!
আমি মৃদুস্বরে বললাম, একথা কেন বলছেন?
তুমি খুব সোজা মেয়ে নও। পিসিমাকে গলা টিপে তুমিই মারোনি তো! তোমার সম্পর্কে এখন থেকে সাবধান হতে হবে। কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড।
আমি চুপ করে রইলাম। আমার জা সুন্দরী নন, আবার অ-সুন্দরীও নন। একটু মোটা হয়ে গেছেন বলে তাঁর ফিগার বলতে কিছু নেই। মুখখানা ঢলঢলে। সেই মুখে নিষ্ঠুরতাও আছে। সেই নিষ্ঠুরতাটাই এবারে ফুটে উঠল। বললেন, আমি তোমার নাম কাউকে বলিনি। বলার দরকারও নেই। আমি জানি, পিসিমার একশ ভরির ওপর সোনা আছে।
আমি ন্যাকা সেজে বললাম, আমাকে কেন বলছেন?
ন্যাকা সেজো না। বেশি ন্যাকা সাজলে পুলিশে ধরিয়ে দেব। জ্যাঠামশাই খবরও দিচ্ছেন আজ থানায়। তোমাকে কোমরে দড়ি বেঁধে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে। চুরি আর খুনের দায়ে।
ভয় পেয়ে বললাম, আমি কিছু করিনি।
কী করেছ তা তোমার বাক্স-প্যাঁটরা খুললেই বোঝা যাবে, যদি না পাচার করে দিয়ে থাকো। তোমার মতো ভয়ঙ্কর মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। তুমি সাঙ্ঘাতিক। ঠাকুরপোকেও একটু সাবধান করে দেওয়া উচিত।
আমার চোখ ভিজে এল। এ গল্প কাকেই বা বলা যায়? কে বিশ্বাস করবে?
জা বললেন, তোমার চোখের জল দেখে ভুলব তেমন পাত্রী পাওনি। শোনো, চুরিই যখন করেছ তখন আর অন্য উপায় নেই। আমি ও গয়নার অর্ধেক চাই। পুরো পঞ্চাশ ভরি। আমার বিশ্বাসী স্যাকরা আছে। সে এসে সমান ভাগ করে দেবে। কাকপক্ষীতেও জানবে না। কাল সন্ধেবেলায় সে আসবে। ও সময়ে কেউ বাড়ি থাকে না। আমার ঘরে ভাগাভাগি হবে। বুঝেছ?
আমি জবাব দিলাম না।
উনি খানিকক্ষণ জবাবের অপেক্ষা করে বললেন, সবটাই একা ভোগ করতে চাও?
রোদে তেতে ওঠা শানে দাঁড়িয়ে আমার পায়ে ফোস্কা পড়ার জোগাড়। উনি চটি পরে আছেন। আমার খালি পা। জ্বলুনি সইতে সইতে বললাম, আমি গরিব-ঘরের মেয়ে বলেই বোধহয় এই সন্দেহ আপনার!
সন্দেহের কোনও ব্যাপারই নয়। আমি দেখেছি। নিজের চোখে। তুমি শুধু গরিবের মেয়ে নও, তুমি ছোটলোকের মেয়ে। আমার কথায় যদি রাজি না হও তা হলে কিন্তু বিপদ আছে, জেনে রেখো।
আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। একবার মনে হল, বলে দিই। বললে একা একটা গোপন কথার ভার আর আমাকে বইতে হবে না। হয়তো জা বিশ্বাস করবেন না। না করলেই বা আমার কী?
হঠাৎ চোখে পড়ল, প্রকাণ্ড ছাদের আর এককোণে একজন সাদা থান পরা বিধবা দড়িতে একটা কাপড় যেন নেড়ে দিচ্ছেন। হঠাৎ তিনি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।
আমি অত গরমেও হিম হয়ে গেলাম। পিসিমা!
এই সময়ে শরিকদের ভাগের সিঁড়ি বেয়ে ওপাশ থেকে একটা মেয়ে চুল শুকোতে ছাদে এল। সে দিব্যি পিসিমার মুখোমুখি বসল, তাকালও। কিন্তু কোনও ভাবলক্ষণ দেখা গেল না। আমি বুঝলাম, মেয়েটা পিসিমাকে দেখতে পাচ্ছে না।
জা বললেন, ওরকম ফ্যাকাসে হয়ে গেলে কেন? ভয় পেয়েছ? ভয় পাওয়া ভাল। ভয় না পেলে কিন্তু সত্যিই বিপদে পড়বে। আর যদি ভাগাভাগি করে দাও তা হলে কোনও ভয় নেই। কাউকে বলব না।
আমি তাঁর দিকে চেয়ে বললাম, আমি কিছু জানি না। আপনি যা খুশি করতে পারেন।
বলে নেমে এলাম। পিসিমাকে দেখে বুক এত কাঁপছিল যে, ঘরে এসে আমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। স্বামী রোজ দুপুরে ঘুমোন। আজও ঘুমোচ্ছন। জেগে থাকলে তিনি আমার অবস্থা দেখে খুবই অবাক হতেন।
আমি জানালার ধারে চুপ করে বসে রইলাম। খাঁ খাঁ দুপুরে একটা ঘুঘু ডাকছে। কাঁচা নর্দমার গন্ধ আসছে। আমার বুক উথাল-পাথাল করছে।