তিনতলায় সন্ধের পর কেউ যায় না। রাতে পিসিমা খৈ আর দুধ খান। খৈ তাঁর ঘরেই থাকে। রান্নার ঠাকুর নন্দ ঘোষাল রাত্রে দুধ গরম করে পৌঁছে দিয়ে আসে।
নন্দ ঘোষালই খবরটা এসে নীচে দিল, পিসিঠাকরুন কেমন যেন হয়ে আছেন। লক্ষণ ভাল নয়।
খবর শুনে আমার শাশুড়ি ওপরে গেলেন। তারপর চেঁচিয়ে ভজহরিকে ডেকে বললেন, ওরে কর্তাবাবু আর দাদাবাবুদের ডেকে আন। ডাক্তার ভদ্রকেও খবর দে। এ তো হয়ে গেছে দেখছি।
পিসিমা মারা যাওয়াতে বাড়িতে কোনও হুলুস্থুল পড়ল না। চেঁচামেচি হল না। বাড়ির পুরুষরা একটু জোর পায়ে ফিরলেন। ডাক্তারবাবু নিঃশব্দে ওপরে উঠলেন এবং পনেরো মিনিটের মধ্যেই নেমে চলে গেলেন।
মৃত্যুসংবাদ পেয়েও পিসিমার ঘরে আমার না যাওয়াটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ দেখাচ্ছিল। কিন্তু তখন আমার ওপরে যাওয়ার সাধ্য ছিল না। বিছানায় পড়ে আমি গড়িয়ে কাঁদছিলাম।
সেই অবস্থায় আমার স্বামীই আমাকে এসে দেখলেন। খুব অবাক হয়ে বললেন, এ কী! এত কাঁদছ কেন? পিসিমার জন্য? এ তো আশ্চর্য কাণ্ড!
আশ্চর্য কাণ্ডই বটে। কারণ আমি ছাড়া বাড়ির আর কেউ কাঁদেনি। আর আমিও মোটেই পিসিমার শোকে কাঁদিনি। কেঁদেছি ভয়ে আর উদ্বেগে। এমন ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটল কেন আমার কপালে?
স্বামী খুব অবাক হলেন। বোধহয় তাঁর মনটাও নরম হল। তিনি ধরেই নিলেন যে আমি পিসিমার শোকে কাঁদছি। বললেন, পিসিমা গিয়ে একরকম ভালই হয়েছে। জীবনে ওঁর কী সুখ ছিল বলো তো! তিনতলার তিনখানা ঘর আগলে বসেছিলেন। দিনরাত গয়না ঘাঁটতেন। আর কোনওদিকে কোনও সুখ বা আনন্দ ছিল না। তুমি যে এত কাঁদছ, তোমার সঙ্গে পিসিমার এত ভাব হল কবে?
আমি জবাব দিতে পারলাম না। কিন্তু স্বামীকে দুহাতে আঁকড়ে বললাম, আপনি শ্মশানে যাবেন না। আমি একা থাকতে পারব না। আমার ভয় করছে।
উনি আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার মনটা যে এত নরম তা জানতাম না তো! বেশ ভাল মেয়ে তুমি।
আমার শাশুড়ি আমাকে ডাকছিলেন, ও ছোটো বউমা! কোথায় গেলে? একবার এসো। এ সময়ে আসতে হয়।
ভজহরিও ডাকতে এল। আমাকে তাই তিনতলায় উঠতেই হল শেষ অবধি। স্বামী আমাকে ধরে ধরেই তুললেন। আমার কান্না দেখে সবাই অবাক।
শাশুড়ি বলেই ফেললেন, ওমা! অত কাঁদার কী?
জা কিছু বললেন না, কিন্তু তিনি যে আমাকে খুব তীক্ষ্ণচোখে নজর করছেন তা আমি টের পাচ্ছিলাম। উনি একটা বাক্স নিয়ে আমাকে নীচে নামতে দেখেছেন।
পিসিমাকে একটা মাদুরে শোয়ানো হয়েছে সিঁড়ির মুখে। শরিকরা সবাই ঝেঁটিয়ে এসেছেন। পাড়াপ্রতিবেশীদের ভিড় জমে গেছে। তবু মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার ভয়-ভয় করছিল। এই বুঝি পিসিমা পট করে আমার দিকে তাকাবেন।
বেশ একটু বেশি রাতেই শ্মশানযাত্রীরা রওনা হয়ে গেল। আমার স্বামী তামার অনুরোধ রাখলেন। নিজে গেলেন না। শরীর খারাপের অজুহাতে রয়ে গেলেন। কেউ তাতে কিছু মনেও করল না।
স্বামীকে ঘটনাটার কথা বলব কিনা তা আমি বুঝতে পারছিলাম না। উনি বিশ্বাস করবেন না। আমি নতুন বউ। আমার সম্পর্কে একটা অন্যরকম ধারণাও হতে পারে। আরও একটা ভয়, পিসিমা গয়নার বাক্সটা সাবধানে রক্ষা করতে বলেছেন। দ্বিতীয় কাউকে না জানানোই ভাল।
পিসিমার সৎকার হয়ে গেল। শ্মশানবন্ধুরা ফিরল। ভোর হল।
সকালে দোতলায় আমার জ্যাঠাশ্বশুরের ঘরে একটা পারিবারিক মিটিং বসল। সেই মিটিং-এ আমাকে ডাকা হয়নি। আমি দুরুদুরু বুকে নিজের ঘরে বসে রইলাম। আমার মন বলছিল, ওঁরা পিসিমার গয়নাগাঁটি এবং তিনতলার দখল কে নেবে তাই নিয়ে আলোচনা করছেন।
ঘণ্টাখানেক বাদে টের পেলাম ওঁরা সবাই মিলে তিনতলায় উঠলেন।
আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না পিসিমার চাবির গোছাটা আমি কোথায় ফেলে এসেছি। ফের যে আঁচলে বেঁধে রেখে আসিনি তা জানি।
ঘণ্টাখানেক বাদে আমার স্বামী থমথমে মুখে নেমে এলেন। তাঁর মুখ দেখে অজানা ভয়ে আমার বুক কাঁপতে লাগল। উনি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ বললেন, পিসিমার গয়নার বাক্স পাওয়া গেল না।
আমার বুকের ভিতরে বোধহয় হঠাৎ এক গেলাস রক্ত চলকে গেল। কাঁপা গলায় বললাম, গয়নার বাক্স?
হ্যাঁ। সোজা কথা নয়, একশ ভরি সোনা। তার মধ্যে পাকা গিনিই তো চল্লিশ পঞ্চাশটা হবে। পিসিমা বিয়েতে যৌতুক পেয়েছিলেন।
আমি অবাক হলাম। একশ ভরি সোনা তো কম ওজন নয়! আমি অত ভারী বাক্স নামিয়ে আনলাম কী করে?
স্বামী খুব চিন্তিত মুখে বললেন, বউদি অদ্ভুত কথা বলছে। বউদি বলছে গয়নার বাক্স কে নিয়েছে তা নাকি জানে। তবে নাম বলছে না। বাবা শুনে বলছে, এ নাকি নন্দ ঘোষালের কাজ। সে-ই তো যেত বেশি পিসিমার ঘরে।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না না। নন্দ ঘোষাল তো পুরোনো লোক।
সেটাই তো কথা। নন্দ ঘোষাল চুরি-টুরি করেনি কখনও।
আমি বিনীতভাবে বললাম, আপনি পিসিমার গয়না নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। ওতে আমাদের কী দরকার?
আমার স্বামী আমার দিকে বিস্মিত চোখে চেয়ে থেকে বললেন, তোমার সোনাদানার ওপর লোভ নেই?
আমি কথা খুঁজে পেলাম। বললাম, লোভ ছাড়া মানুষ নেই। সাধুসন্ত গেরস্থ সবারই কম-বেশি লোভ থাকবেই। স্বয়ং ভগবানই মানুষের ভক্তির ওপর লোভ করেন।
আমার স্বামী অকপট শ্রদ্ধার সঙ্গে আমার দিকে তাকালেন। তিনি আমাকে আবিষ্কার করতে শুরু করেছেন। বললেন, খুব ভাল কথা। কিন্তু বাক্সটা যাবে কোথায়?