আমার মাঝে মাঝে বিকেল বা সন্ধেবেলায় খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে করে। ঘরগুলো এত বিষণ্ণ, এত প্রকাণ্ড, আর এত ভুতুড়ে যে আমি বিকেল আর সন্ধেবেলাগুলো কিছুতেই ঘরে বসে কাটাতে পারি না। ছাদে গেলে তবু ফাঁকা বাতাসে কিছুক্ষণ শ্বাস নেওয়া যায়। একটু পায়চারি করতে পারি, গুনগুন করে গান গাইতে পারি। বাড়ির ছাদটা এজমালি বলে শরিকদের পরিবারের লোকজনও আসে। তাদের মধ্যে দু-চারজন আমার বয়সী মেয়ে-বউ আছে। দু-চারটে কথা হতে পারে তাদের সঙ্গেও। কিন্তু ছাদে যাই না পিসির ভয়ে। খুব সন্তর্পণে সিঁড়ি দিয়ে উঠলেও উনি ঠিক টের পান। ঘরের দরজা খোলা রেখে সিঁড়ির দিকে মুখ করেই বসে থাকেন।
কিন্তু সেদিন আমার ঘরে এতই খারাপ লাগছিল যে, পিসির ভয়কে মাথায় নিয়েও আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে যাচ্ছিলাম। আমার অনেক চিন্তা, অনেক ভয়, অনেক উদ্বেগ। বিয়ের পরেকার যে আনন্দ অন্য সব মেয়ের হয় আমার যেন সেরকম নয়। আমার মনে হচ্ছিল, বিবাহিত জীবনে আমাকে অনেক ভার বইতে হবে, যা আমি হয়তো পেরে উঠব না।
তিনতলায় উঠছি খুব সন্তর্পণে। পা টিপে টিপে। সিঁড়ির মুখোমুখিই পিসির ঘর। আলো জ্বলছে। আমি উঁকি মেরে দেখে নিলাম, পিসি রোজকার মতোই সিঁড়ির দিকে মুখ করে বসে আছেন। ফসা রং, বড় বড় চোখ যেন গিলে খাচ্ছে চারদিককে। একসময়ে খুব সুন্দরী ছিলেন। সৌন্দর্যের কোনও আরতি হয়নি, ভোগে লাগেনি কারও, যৌবন বয়ে গেছে বৃথা। পিসির জীবনটা যে কিরকম হাহাকারে ভরা তা আমি জানি। ভাগ্যের ওপর, দেশাচার কুলাচারের ওপর রাগ করে লাভ নেই। তাই তাঁর রাগ নিরীহদের ওপর ফেটে পড়ে। আমি ওঁকে ভয় পাই ঠিকই, কিন্তু ঘেন্না করি না।
সিঁড়ির শেষ কয়েকধাপ বাকি থাকতে আমি থামলাম। সিঁড়ির মুখটা পেরোতে সত্যিই ভয়-ভয় করছিল। আমি আর একবার সন্তর্পণে উঁকি দিয়ে একটু অবাক হয়ে গেলাম। পিসি স্থির হয়ে বসেই আছেন। চোখ খোলা এবং পলকহীন। মুখটা হাঁ হয়ে আছে। কেন কে জানে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। দৃশ্যটা স্বাভাবিক নয়।
আমি সিঁড়ি কটা ডিঙিয়ে পিসির ঘরে ঢুকলাম। পিসিমা! ও পিসিমা!
পিসিমা! ও পিসিমা!
পিসিমা জবাব দিলেন না। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে মস্ত বড় মোড়ায় যেমন বসেছিলেন তেমনই বসে রইলেন।
আমি সাবধানে তাঁকে ছুঁলাম। নাকের কাছে হাত ধরলাম। তারপর আমার নিজের হাত-পা যেন হিম হয়ে এল। পিসিমা বোধহয় বেঁচে নেই।
তাড়াতাড়ি ছুটে নীচে আসতে যাচ্ছি। হঠাৎ পিছন থেকে পিসিমার গলা পেলাম, দাঁড়াও। খবরটা পরে দিলেও হবে।
আমি চমকে ফিরে তাকালাম। তা হলে কি পিসিমা মারা যাননি। কিন্তু একই রকমভাবে বসে আছেন। চোখ বিস্ফারিত, মুখ হাঁ করা। সেই হাঁ করা মুখ একটুও নড়ল না। কিন্তু পিসিমার কথা শোনা যেতে লাগল, মরেছি রে বাবা, মরেছি। তোমাদের আপদ বিদেয় হয়েছে।
আমি জীবনে এত ভয় পাইনি কখনও। হার্টফেল হবে নাকি আমার।
তিনতলাটা খুব পছন্দ তোদের, না? আমি মলেই এসে দখল নিবি বুঝি? আর গয়না, টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করবি? কোনওটাই হবে না। দাঁড়িয়ে আছিস যে বড়! আয় ইদিকে! কাছে আয়!
ওই হুকুমটা যেন চুম্বকের মতোই একটা জিনিস। ধীরে ধীরে পিসির দিকে টেনে নিচ্ছে আমাকে।
কোথায় পালাচ্ছিলি?
আমি জবাব দিতে পারি না। গলা বোজা। শুধু চেয়ে আছি। পিসির মৃত চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে।
আঁচল থেকে চাবি খুলে নে। উত্তরের ঘরে যাবি। কাঠের বড় আলমারিটা খুলে দেখবি তলায় চাবি-দেওয়া ড্রয়ার, ড্রয়ার খুললে একটা আলপাকা জামায় মোড়া কাঠের বাক্স পাবি। নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখবি। কেউ টের না পায়। ভাবছিস তোকে দিচ্ছি? কচুপোড়া। মরেছি টের পেলে সব এসে ভাগাড়ে শকুনের মতো পড়বে। তাই সরিয়ে দিচ্ছি। লুকিয়ে রাখবি। ও আমার সাধের গয়না, বিধবা বলে পরতে পারিনি। যদি কখনও পরিস তা হলে ঘাড় মটকে দেব। একটা রতিও যেন এদিক ওদিক না হয়। যা।
মৃতা পিসিমার আঁচল থেকে কিভাবে চাবি খুলেছিলাম আর কিভাবে সেই গয়নার বাক্স বের করেছিলাম তার কিছুই আমি বলতে পারব না। আমার কিছুই স্পষ্ট করে মনে পড়ে না। তবে আমি খুব সচেতনভাবে কাজটা করিনি।
বাক্সটা আঁচলে আড়াল করে ঘরে আসবার সময় দুজন আমাকে দেখতে পায়। একজন আমার জা বন্দনা। বন্দনাদি তখন চাকর ভজহরিকে ডাকতে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে মুখ করে ছিলেন। ভজহরি তার ডাকে উঠে আসছিল। আমি জাকে পাশ কাটিয়ে যখন নেমে যাচ্ছিলাম তখন আমি প্রায় দৌড়োচ্ছি। না তাকিয়ে দেখে ভজহরিকে বললেন, ওটা বউ না ঘোড়া? গেছে মেয়েছেলে বাবা!
ভজহরি আমাকে নামতে দেখে দেওয়ালের দিকে সরে দাঁড়িয়েছিল। সেও আমাকে দেখল।
ওপর থেকে জা ভজহরিকে বলল, কাঁকালে ওটা কী নিয়ে গেল রে? ভজহরি বলল, বাক্সমতো কী যেন!
ভজহরি বলল, বাক্সমতো কী যেন!
বাক্স! বাক্স পেল কোথায়?
আমি এটুকুই শুনতে পেয়েছিলাম। ঘরে এসে দরজাটা বন্ধ করে আমার নতুন ট্রাঙ্কের একদম তলায় বাক্সটা লুকিয়ে রেখে চাবি বন্ধ করে দিলাম। নামিয়ে আনার সময় খেয়াল হয়নি, বাক্সটা কতটা ভারী। রাতের দিকে যখন হাতটা ব্যথা করতে লাগল তখন বুঝলাম।
পিসিমা যে মারা গেছেন এ খবরটা কি আমার সবাইকে দেওয়া উচিত? কিন্তু খবর দেব কি? ঘরে এসে এমন বুক কাঁপতে লাগল, এমন হাঁফ ধরে গেল, মাথাটা এত গণ্ডগোল লাগতে লাগল যে, আমাকে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে হল। ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছে কিনা, না কি কী হল, সেটাও ঠিক করতে পারছিলাম না।