তুই একটা রাক্ষুসী। বুকটা এমন করছে আমার! কী সব যা তা বললি বল তো!
একটু ভেবে দেখিস প্রীতি।
আমার মনটা এত খারাপ লাগছে।
তুই বোকা। তাই জীবনে সুখী হবি। বোকা না হতে পারলে সুখ নেই।
রাতে যখন মস্ত টেবিলে সবাই খেতে বসেছি তখন খেতে খেতে হঠাৎ জ্যেঠু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, শোন বসন। একটু ভেবে একটা কথার জবাব দিস।
আমার খাওয়া থেমে গেল। জ্যেঠুর দিকে চেয়ে বললাম, কী বলবে তা আমি জানি। আমার জবাব হল, না। কিছুতেই না।
সবাই চোখাচোখি করল। নীরব হয়ে গেল।
জ্যেঠু খুব মৃদুস্বরে বলল, ঠিক আছে। তবে ছেলেটা অনেক দিন অপেক্ষা করে ছিল। বিয়ের নাকি প্ল্যানই ছিল না। বাড়ি থেকে খুব চাপাচাপি করায় বলেছে, আমি যার জন্য এতকাল অপেক্ষা করেছি… থাক গে। অমত জানিয়ে দেওয়াই ভাল।
আমি ঘরে চলে এলাম। আমার তিনটে ঘর জুড়ে হু-হু করে এক নির্জনতা বয়ে যেতে লাগল।
দু দিন পর এক ছুটির দুপুরে সুমিতা আমার কার্ডিগান নিয়ে এল। মুখটা শুকনো। বলল, পরে দেখ তো, ফিট করছে কিনা।
পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। বেশ ভাল হয়েছে। সুমিতার হাত খুব ভাল।
পছন্দ?
খুব।
সুমিতা বসল। বলল, কার্ডিগানটা শেষ করার জন্য দুদিন রাত জাগলাম। ভাবলাম, এবার শীত পড়েছে, বসনটা হয়তো কার্ডিগানটা ছাড়া কষ্ট পাবে।
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, দূর, তাড়া ছিল না তো! আমার কত আছে।
তা কি জানি না? তবু ভাবছিলাম, হয়তো এটার জন্যই বসে আছিস। শখের জিনিস তো!
কেন কষ্ট করতে গেলি?
কারও কারও জন্য কষ্ট করেও আরাম আছে। তোরা আমাদের জন্য কম করেছিস? অভাবের দিনে মা তো কাকিমার কাছেই ছুটে আসত!
দেখ সুমি, ওসব শুনলে আমার রাগ হয় তা জানিস? যাদের আছে তারা তো দিতেই পারে। ওতে মহত্ত্বটা কী আছে শুনি!
সুমিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কাকিমার একটা কথা আমার খুব ভাল লাগত। কাকিমা বলত, আমি অন্যের দীর্ঘশ্বাস সইতে পারি না।
আমার মা একজন মহৎ মহিলা, আমি জানি। আমি সেরকম মহৎ হতে পারব না হয়তো! অমন পতিভক্তি, অমন সংসারের মায়া, অমন অভাবের সঙ্গে লড়াই-না, আমি পেরে উঠব না।
সুমিতা হঠাৎ বলল, দাদা কাল চলে যাচ্ছে।
আমি আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায়ের কার্ডিগানটা দেখতে লাগলাম।
সুমিতা মৃদুস্বরে বলল, তুই ফিরিয়ে দিলি দাদাকে?
আমি জবাব দিলাম না।
সুমিতা একটু ছলছল চোখ করে বলল, আমরা তো জানতাম না যে, দাদার তোকেই পছন্দ। কে জানে কেন। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, বসনকে তুমি কবে দেখলে দাদা, তুমি তো মেয়েদের মুখের দিকেই তাকাও না। ছিলেও না তো এদেশে। বসনকে তাহলে কবে পছন্দ করলে। দাদা শুধু বলে, ও তুই বুঝবি না। বসনের একটা শোধবোধ পাওনা আছে। কী মানে কথাটার তা জানি না। তুই জানিস?
না তো! আমার সমস্ত শ্রবণ জুড়ে সেই অদৃশ্য হু-হু শব্দের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বধির করে দিচ্ছে আমাকে।
কত বিয়ের প্রস্তাব আসছে, সব ফিরিয়ে দিল দাদা।
শোন সুমি, তোর দাদাকে খুব গোপনে একটা কথা বলতে পারবি?
কি কথা?
আগে আমার গা ছুঁয়ে দিব্যি কর যে, তোর দাদা ছাড়া কাউকে কখনও বলবি না।
আমার ভয় করছে। আচ্ছা, দিব্যি করছি। খারাপ কিছু বলবি না তো!
খারাপ। আমাকে ছুঁয়েছিস, বাড়িতে গিয়ে ভাল করে ডিজইনফেকট্যান্ট দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলিস।
সুমিতা চমকে উঠে বলে, কেন রে?
শোন, খুব বিশ্বাস করে বলছি তোকে। আমার বাড়ির কাউকে বলিনি। বললে খুব হৈ-চৈ হবে। জানিস তো, আমি কত আদরের।
বল না বসন। আমার বুক কাঁপছে।
আমি চমৎকার একখানা অভিনয় করলাম। হঠাৎ শাড়ির আঁচল তুলে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম। তারপর কান্নার মধ্যেই বললাম, আমার কুষ্ঠ হয়েছে রে।
সর্বনাশ!
গোপনে ডাক্তার দেখিয়েছি। কাউকে বলিনি।
সুমিতা পাথরের মতো বসে রইল।
খানিকক্ষণ কেঁদে আমি আমার ট্র্যাজিক মুখখানা উন্মোচন করে ধরা গলায় বললাম, তোর দাদাকে বলিস।
সুমিতা ভীত মুখে চেয়ে ছিল আমার দিকে। তারপর বলল, কেন হল রে? ঠিক জানিস তো?
তিনজন ডাক্তার একই কথা বলেছে।
আমি বাঁ হাতখানা খুলে একটু দেখালাম ওকে। ক্ষতের ওপর পুরু ক্রিম দেওয়া ছিল বলে এমনিতেই বিচ্ছিরি দেখাচ্ছিল হাতটা। তার ওপর সুমিতার সাহসই হল না ভাল করে দেখার। সে মুখ ঢেকে ফেলল। হয়তো চোখে জল এল ওর।
বোকা সুমিতা থমথমে মুখ করে চলে যাওয়ার পর একা ঘরে আমার হেসে ওঠাই হয়তো উচিত ছিল। কিন্তু তার বদলে কান্না এল। প্রেমকে আমার কেন বিশ্বাস হয় না?
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন প্রায়ই দেখতাম, আমাদের সদর দরজার চৌকাঠের পাশে রোজ ভোরবেলা কে বেশ একটা রক্তগোলাপ রেখে যায়। পরে বড় হয়ে একটু একটু করে জেনেছি, যে আমার মায়ের কোনও ব্যর্থ প্রেমিক। প্রতিদিন সে তার রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডের প্রতীক রেখে যেত দরজার বাইরে। ওই গোলাপটি কুড়িয়ে নেওয়ার লোভে রোজ আমি ভোরবেলা উঠে সদর দরজা খুলতাম। একদিন বোধহয় একটু আগেই দরজা খুলে ফেলেছিলাম। সেদিন লোকটাকে দেখতে পেয়ে যাই। লম্বা, সুন্দর চেহারার একজন মানুষ। হাতে গোলাপ, আমাকে দেখে যেন প্রথমটায় ভয় পেল। তারপর লজ্জায় একটু হাসল। গোলাপটা আমার হাতে দিয়ে কিছু না বলেই চলে গেল। কী যে ভাল লেগেছিল আমার সেদিন!
অনেকদিন হয় আর কেউ গোলাপ রেখে যায় না আমাদের দরজায়। প্রেম কি ফুরিয়ে যায়? ক্লান্ত হয়? শেষ হয়? প্রেম ভয় পায়?