নতুন একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে শহরে। খুব নাম হয়েছে। বিকেলে জ্যেঠু নিয়ে গেল সেখানে খাওয়াতে। বেশ ঝা চকচকে দোকান। মফস্বল শহরের পক্ষে দারুণ রেস্টুরেন্ট।
জ্যেঠুর ব্লাডসুগার ধরা পড়েছে। খাওয়া দাওয়ায় অনেক বারণ আছে। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, তুমি কিন্তু সব খাবে না। মেনু দাও, আমি বেছে দিচ্ছি।
জ্যেঠু মুখখানা তোম্বা করে বলে, ওরে, একদিনে কিছু হয় না।
না জ্যোঠু, ব্লাডসুগার খুব খারাপ জিনিস। তুমি স্টু আর স্যালাড খাও। আর দুখানা তন্দুরী রুটি।
দু চামচ ফ্রায়েড রাইস খাই?
আচ্ছা, আমার প্লেট থেকে তুলে দিচ্ছি।
তোর কী হয়েছে বল তো! মুখচোখ ফ্যাকাসে লাগছে।
তোমরা সবসময়ে আমাকে লক্ষ্য করো কেন জ্যেঠু? আর কোনও কাজ নেই বুঝি তোমাদের?
আচ্ছা খা। কী যেন একটা বলি বলি করছিল জ্যেঠু। বার বার চেষ্টা করল। বলল না।
সন্ধেটা বেশ কাটল। সুস্বাদু খাবারের পর জ্যেঠু নিয়ে গেল ভিডিও গেম খেলতে। আজ কী যে হল, একদম ভাল স্কোর করতে পারলাম না।
রাতে সারা শরীর জুড়ে ব্যথার তানপুরা বাজতে লাগল। তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, ঝঙ্কার তুলছে ব্যথা। চোটটা কতখানি তা আমি পড়ে গিয়ে এমন টের পাইনি ভাল করে। একটু জ্বর-জ্বরও লাগছে কি? একটু বেশি শীত করছে না? তার চেয়েও বেশি, ঘরে একটা হু-হু করে বয়ে যাওয়া কিছু। কী বয়ে যায় আমার ঘরে?
ঘুম আসছিল না। উঠে তিনটে ঘরের আলো জ্বেলে দিলাম। তারপর এ ঘর থেকে ও ঘর ঘুরে বেড়াতে লাগলাম ভূতগ্রস্তের মতো। এইসব ঘরে একদিন ঘুরে বেড়াত আমার সেই বালবিধবা ঠাকুমা রসময়ী। তার জীবনে কোনও রসকষ ছিল না, আনন্দ ছিল না। রসময়ী রেস্টুরেন্টে খেতে পারত না। স্কুটার চালাত না। ভিডিও গেম খেলতে যেত না। রসময়ী শুধু গয়না হাঁটকাত। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলত। শুধু নিঃসঙ্গতার হাত ধরে বসে থাকত। রসময়ীর বুকের সেই শূন্যতাই কি হু হু করে বয়ে যায় এই ঘরে? তার দীর্ঘশ্বাসই কি কানে আসে আমার?
আলমারির গায়ে মস্ত আয়না। আমি মুখোমুখি টুল পেতে বসলাম। দাদু বলত, বসনের মুখে রসময়ীর আদল আছে।
আছে, আমি জানি। রসময়ীর কয়েকটা ফটো আছে অ্যালবামে। একটু বেশি বয়সের ফটো। তবু মুখের আদল তো বদলায় না। নিখুঁত সুন্দরী। আজ রসময়ীর জন্য আমার একটু কষ্ট হচ্ছিল। আমার জন্য নাকি গয়না রেখে গেছেন তিনি। বড় অবাক কথা। আমি যে জন্মাব তা রসময়ী জানতেন কী করে?
সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছিলাম না। হাত টাটাচ্ছে, কোমর ব্যথায় অবশ, মাথা ধরেছে। শরীরে বাজছে জ্বরের বাঁশি। তার চেয়েও বড় কথা এই শীতের রোদ-ঝলমল সকালেও আমার চারদিকে সেই হু-হু। সেই খাঁ-খাঁ।
শরীর খারাপ টের পেলে সমস্ত বাড়িটা এসে হামলে পড়বে আমার ওপর। ডাক্তার আসবে, ওষুধ আসবে, বড়মা আর ঠাকুমা এসে থানা গাড়বে ঘরে। সে বড় জ্বালাতন। ছোটোখাটো অসুখ বিসুখ আমি তাই চেপে যাই।
কলেজে যাওয়ার জন্য ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে নিচ্ছিলাম। বড়মা ঘরে এল, কলেজে যাচ্ছিস নাকি?
হ্যাঁ বড়মা।
বেশ।
বড়মা কিছু একটা বলতে চায় আমাকে। সাপের হাঁচি বেদেই চেনে। ওই মুখচোখ, এই অকারণে এসে কলেজে যাচ্ছি কি না খোঁজ নেওয়া এসব পূর্বলক্ষণ আমার চেনা।
জানিস তো, যতীন বোসের বড় ছেলেটা ফিরেছে।
ওটা কোনও খবর নয় বড়মা। সুমিতা আমার বন্ধু।
ও হ্যাঁ, তাই তো! ছেলেটা কিন্তু বেশ।
আমি জবাব না দিয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে লাগলাম।
বড়মা বললেন, এইসব বলছিল আর কী, বিয়ের কথা টথা চলছে।
আমি বড়মার দিকে ফিরে একটু হাসলাম, কথাটা কী বড়মা?
বড়মা একটু ভয় খেয়ে বলে, ওরে, সে আমি বলিনি। তোর জ্যেঠুই বলছিল, ছেলেটা বড় ভাল। গরিবের ছেলে, স্ট্রাগল করে এত বড় হয়েছে।
বড়মা, আমি আঁচ করতে পারছিলাম।
রাগ করলি নাকি?
না। তোমাদের ওপর রাগ করব কেন? কিন্তু দোহাই তোমাদের, ভুলেও কোনও প্রস্তাব দিও না।
কেন রে?
কারণ আছে।
কলেজেই বেশ বেড়ে গেল জ্বরটা। ক্লাসের পড়া শুনব কী, সারাক্ষণ কানে এক হুতাশনের হু-হু শব্দ। বুকের মধ্যে খাঁ-খাঁ। অফ পিরিয়ডে কলেজের মাঠে রোদে পিঠ দিয়ে গাছতলায় বসে রইলাম। পাশে বসে প্রীতি তার নীতীশের কথা বলতে লাগল। বকবক বকবক। আমার কানে ঢুকলই না। কানে কেবল সেই হু-হু। ঘর-সংসারের মধ্যে যে কী পায় মানুষ!
আমি হঠাৎ প্রীতির দিকে চেয়ে নিষ্ঠুরের মতো বললাম, তোর নীতীশ তোকে কতটা ভালবাসে?
প্রীতি লজ্জা পেয়ে বলে, আর বলিস না। যা পাগল। ওর শ্বাসে প্রশ্বাসে নাকি আমার চিন্তা।
দেখ প্রীতি, যদি ধর হঠাৎ কেউ তোর মুখে অ্যাসিড বাল্ব ছুঁড়ে মারে আর তোর মুখটা যদি ভয়ংকরভাবে পুড়ে যায় একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়, যদি তুই দেখতে বীভৎস হয়ে যাস, তাহলেও কি তোর নীতীশ তোকে বিয়ে করবে? ভালও বাসবে?
প্রীতির মুখটা যা দেখতে হল বলার নয়। আমার দিকে চেয়ে হাঁ করে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, মাগো! তুই কি ডাইনী? ওসব অলক্ষুণে কথা বলে কেউ?
আমি একটা ঘাসের ডাঁটি চিবোতে চিবোতে আনমনে বললাম, ওসব ভালবাসার কোনও দাম আছে যা রূপ-নির্ভর, অবস্থা-নির্ভর, কন্ডিশনাল? আমি বিশ্বাস করি না রে, আমি ভালবাসায় একদম বিশ্বাস করি না। প্রেমিক-প্রেমিকাদের সম্পর্কটা ভীষণ ঠুনকো।