ও দিয়ে আমি কী করব? কে দিয়ে গেছে?
তোমার এক ঠাকুমা। দুঃখী মানুষ ছিলেন। এইসব গয়না ছিল তাঁর বুকের পাঁজর।
কে ঠাকুমা?
তুমি তাঁকে দেখোনি। রসময়ী।
আমি হাসলাম, ছবি দেখেছি। দারুণ সুন্দরী ছিলেন। আমি তো তাঁরই ঘরদোর বিছানা দখল করে আছি। না?
তুমি নিজের অধিকারেই আছ। দখল করতে যাবে কেন?
গয়নাগুলো আজই বের করলে কেন?
মা আর বড়মা নিজেদের মধ্যে একটু রহস্যময় চোখাচোখি করে নিলেন। খুব মৃদু একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পেলাম যেন!
আসছি মা। আমার অনেক কাজ আছে।
এসো।
মাথায় হেলমেট চাপিয়ে স্কুটারে ভেসে যেতে যে কী রোমান্টিক মাদকতা আছে কেউ বুঝবে না। ঝাঁঝালো ঠাণ্ডা বাতাস নাক মুখ দিয়ে ঢুকে মগজ থেকে গয়নাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। মা বড়মা এদের আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। বড্ড সেকেলে। কেবল সোনাদানা, গয়না নিয়ে পড়ে থাকবে। পৃথিবীটা যে কত সুন্দর তা উপভোগ করে কই এরা?
দু জায়গায় ঘুরে, আড্ডা মেরে যখন সুমিতাদের বাড়ি পৌঁছলাম তখন দুপুর। স্কুটারটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ডাকলাম, সুমিতা, এই সুমিতা।
বাইরের ঘরে একটি শান্ত চেহারার দীর্ঘকায় পুরুষ বসে আছে সোফায়। অল্প একটু দাড়ি মুখে। মাথায় এলোমেলো চুল। উদাসীন মুখ। অনেক পাল্টে গেছে, তবু এ মুখ আমি ইহজন্মে ভুলব না। আমি থমকে গেলাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকাল আমার হৃৎপিণ্ড। তারপরই কোন অতীত থেকে মার মার করে লুঠেরা সৈনিকদের মতো ছুটে এল অপমানের স্মৃতি।
এক গাঢ় গম্ভীর স্বর বলল, সুমিতা? সুমিতা বোধহয় ওপরে আছে।
আমি ঘরটা পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম, কি করছি তা টের না পেয়েই।
সুমিতা উল ছড়িয়ে বিছানায় বসা। আলুথালু চেহারা। আমাকে দেখেই করুণ গলায় বলে উঠল, আজও হয়ে ওঠেনি রে! কী করব বল, পরশু দাদা এসেছে এতদিন বাদে। শুধু হৈ-চৈ হচ্ছে। কিছু করতে পারছি না। বোস না। দাদা তোকে দেখল?
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ।
কথা বললি?
কেন?
সুমিতা উলের কাঁটায় মন দিতে মাথা নিচু করে বলে, এমনি।
না এমনি নয়। ঘটনার ভিতর দিয়ে আমি একটা আবছা প্যাটার্ন দেখতে পাচ্ছি। আমার ভিতরটা শক্ত হয়ে উঠছে। আমি রেগে যাচ্ছি। কিন্তু বলতে পারছি না।
সুমিতা মৃদু স্বরে বলল, এতদিন অমেরিকায় ছিল। কত কষ্ট করেছে বল। বিদেশে গিয়েও প্রথম দিকে খুব কষ্ট করতে হয়েছে।
এসব শুনে আমার কোনও লাভ নেই। তাই চুপ করে বসে রইলাম।
সুমিতা বলে, কাল নাকি তোদের লরি খারাপ হয়েছিল রাস্তায়।
হ্যাঁ।
ইস, আমি এ বছর যেতে পারলাম না। দাদা এল তো। কী করে যাব বল! কথাই ফুরোচ্ছে না।
আজকাল দাদার সঙ্গে কথা বলিস? আগে তো ভয় পেতি।
তখন কি দাদা এরকম ছিল, না আমরাই ছিলাম! বড় হয়েছি না?
তোর দাদার অহংকার কমেছে?
সুমিতার মুখটা কালো হয়ে গেল।
একটু চুপ করে থেকে বলল, অহংকার! দাদার অহংকার করার মতো কী ছিল বল! খেতে পেতাম না আমরা, চেয়েচিন্তে চলত। দাদা এত লাজুক ছিল যে কোনওদিন কিছু মুখ ফুটে চাইতে পারত না। ওর খিদে পেলে আমরা কখনও টের পেতাম না। না রে, দাদা অনেক কষ্ট পেয়েছে।
ভাল।
তুই কি দাদাকে ওরকম ভাবিস?
আমি তো অমলেশদা সম্পর্কে কিছু জানি না, কী ভাবব?
তবে যে অহংকারের কথা বললি!
ভাল ছাত্র ছিলেন, অহংকার থাকতেই পারে।
ওরকম বলিস না রে! আমেরিকায় যা স্কলারশিপ পেত তার বেশির ভাগটাই পাঠিয়ে দিত আমাদের। নিজে আধপেটা খেয়ে থাকত। দিনরাত পড়ত।
ওসব শুনে আমার কী হবে?
দাদাকে কেউ কখনও খারাপ বলেনি রে!
কার্ডিগানটা হলে ওটা তুই আমাকে দিয়ে আসিস। শুধু হাতটা পুরো করিস না থ্রি কোয়াটার করিস।
সুমিতা মাথা নেড়ে বলে, ঠিক আছে। একটু দেরি হবে কিন্তু। দাদা আছে তো, তাই।
সুমিতা আমাকে এগিয়ে দিতে এল নীচে। স্কুটারে ওঠার আগে যখন হেলমেট পরছি তখন শুনলাম সুমিতা বারান্দা থেকে তার দাদাকে চাপা গলায় ডেকে বলল, দাদা, এই বসন।
গাঢ় স্বরটি বলল, জানি।
আজ বহুকাল বাদে সেই অপমান আমার সর্বাঙ্গে বেশ জলবিছুটির মতো জ্বলছে। বার বার দাঁতে দাঁত পিষে ফেলছি। স্কুটার আমি এত জোরে চালাইনি কখনও। কাছেই বাড়ি, মাত্র তিনটে বাড়ি পর। তবু এত জোরে স্কুটার ছেড়েছি যে সময়মতো থামতে পারলাম না। বেমক্কা ব্রেক কষলাম। স্কুটারটা সেই ধাক্কায় ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠল। তারপর স্কুটার এক দিকে, আমি অন্যদিকে ছিটকে গেলাম। কী জোর লাগল বাঁ হাতটায়! চোখ ভরে এল জলে। রাস্তার অপমানশয্যা ছেড়ে যখন উঠলাম, তখন শরীরের চেয়েও ব্যথা অনেক বেশি হচ্ছিল মনে।
রাস্তায় লোক জড়ো হওয়ার আগেই স্কুটারটা টেনে তুলে আমি ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে এলাম।
তিনতলায় আমার নির্জনতায় ফিরে এসে দেখলাম, বাঁ হাত কনুই পর্যন্ত ছড়ে ছত্রখান হয়েছে। রক্ত পড়ছে খুব। মাথাতেও লেগেছে, হেলমেট ছিল বলে ততটা নয়। কোমরেও কি বেশ চোট? হবে। কিন্তু সেসব আমাকে একটুও কাহিল করল না। আমি ঘরে এসে চুপ করে বসে রইলাম চেয়ারে। ভূতগ্রস্তের মতো। তিনতলায় ঘরদোরের সেই শ্রুতির অতীত কিছু একটা হু-হু, করে বয়ে যাচ্ছে। বড় বেশি হু-হু। বড় বেশি খাঁ-খাঁ।
ধরা পড়লে বকুনি খেতে হবে, বন্ধ হবে স্কুটার চড়া। তাই ক্ষতস্থান ধুয়ে অ্যান্টিসেপটিক লাগাতে হল। শীতকাল বলে সুবিধে, একটা ফুলহাতা ব্লাউজ পরে রইলাম। কিন্তু সব ক্ষতই কি চেপে ঢেকে রাখা যায়? বয়ঃসন্ধিতে বুদ্ধিভ্রংশতাবশে লেখা একটি নিদোষ চিঠির জবাবহীনতার অপমান আজ শতগুণে ফিরে আসে কেন?