এ কি তোমাদের আমল বড়মা? এ যুগের মেয়েরা সব পারে।
সব পেরো মা, সব পেরো। শুধু দয়া করে মেয়ে থেকো। ব্যাটাছেলে হয়ে যেও না। যা রকম সকম দেখছি, এরপর মেয়েদের গোঁফদাড়ি না গজালে বাঁচি।
আমি হাসি চাপতে পারলাম না। বললাম, কী যে সব বলল না, বড়মা? এ যুগের মেয়েদের তোমার খুব হিংসে হয়, না?
তা একটু হয়। এই বলে বড়মা আঁচলের আড়ালে থেকে একটা ছোট্ট রেকাবি বের করে বলল, এ দুটো খেয়ে নে তো। টাটকা করেছি।
দেখি, গোকুল পিঠে। আপনা থেকেই নাক কুঁচকে আসছিল। দু চক্ষে দেখতে পারি না পিঠে-পায়েস। কিন্তু সে কথা প্রকাশ করার উপায় আছে? শুধু বললাম, আমাকে মুটকি আর ধুমসি না বানালে তোমার সুখ নেই, না?
ওমা! কথা শোনো! মুটকি কেন হতে যাবি।
যাব না? মিষ্টি বেশি খেলে ক্যালোরি ইনটেক কত বেড়ে যায় জানো।
জন্মে শুনিনি। খা। শীতকালে একটু খেতে হয়। আজ পৌষ পার্বণ।
আমার কী পছন্দ জানো?
খুব জানি। ওই কেঁচোর মতো কিলবিলে জিনিস আর গোপালের ঝাল সিঙ্গাড়া। ওইসব খেয়েই তো চেহারা হাড়গিলে হচ্ছে।
হাড়গিলেদেরই আজকাল কদর। হাঁ করছি, মুখে দিয়ে দাও। রসের জিনিস আমি হাতে ধরব না। হাত চটচট করবে।
বড় করে হাঁ কর। গরম কিন্তু। বিষম খাস না আবার।
বলতে নেই, মায়ের চেয়ে বড়মার সঙ্গেই আমার বেশি মাখামাখি। বড়মা খোলামেলা, কথা চেপে রাখতে পারে না। তার আদরের মধ্যে জোর করে খাওয়ানো, শরীর নিয়ে চেঁচামেচি, মেয়েদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে মতামত সবই আছে। তবু বড়মাকে আমি যখন তখন পটিয়ে ফেলতে পারি। যে কোনও আবদার করে আদায় করতে পারি।
বছর দেড়েক আগে জ্যেঠু যখন আমাকে স্কুটার কিনে দেয় তখন বড়মার মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। জ্যেঠুর সঙ্গে তুমুল বাকবিতণ্ডাও হয়েছিল। এমন কাণ্ড নাকি বড়মা কখনও দেখেনি। পরে সেই বড়মাকেই আজকাল আমি স্কুটারের পিছনে চাপিয়ে এখানে সেখানে নিয়ে যাই।
বড়মা বলে, তুই আসলে ব্যাটাছেলেই। ভুল করে মেয়ে হয়ে জন্মেছিস।
বড়মা জানে না, আমি কী ভীষণ মেয়ে। আমি মেয়ে বলে আমার একটুও দুঃখ নেই। যা বড়মার হয়তো বা আছে। মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে আমি ভীষণ খুশি। যদি জন্মান্তর থাকে আমি বারবার মেয়ে হয়েই জন্মাতে চাই। আমি তো চাই পৃথিবীটা শুধু মেয়েদের হোক। পুরুষ থাকার কোনও দরকার নেই। শুধু মেয়েদেরই পৃথিবী হলে কী ভাল হত! না, তা বলে বাবা, জ্যেঠু আর আমার দুটো দাদুকে বাদ দিয়ে নয়। পুরুষ বলতে পৃথিবীতে থাকবে শুধু ওই চারজন। বাবা, জ্যেঠু, দুটো দাদু। ব্যস।
আজ ছুটি। আজ আমার অনেক প্রোগ্রাম। গান শিখতে যাব, শর্বরীদের বাড়িতে যাব আবার দুটো সায়েন্সের খাতা আনতে, সুমিতা আমার একটা কার্ডিগান বুনছে—সেটার ডিজাইনটা একটু বদলাতে বলে আসতে হবে।
নীচে নামতেই ডাকল, বসন, জলখাবার খেয়ে একবার আমার ঘরে এসো।
গলাটা কি একটু গম্ভীর শোনাল? আমার মা একটু গম্ভীর।
মায়ের ঘরটা এঁদো, অন্ধকার, বিচ্ছিরি। তার মধ্যে আবার বাক্স প্যাঁটরা, সিন্দুক কত কী। খাটে বড়মা পা ঝুলিয়ে বসে। সিন্দুকের সামনে মা। মায়ের সামনে মেঝেতে রাখা একটা মস্ত গয়নার বাক্স।
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো।
আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
মা অদ্ভুত এক চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, এই বাক্সটা চিনতে পারো? কিছু মনে পড়ে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না তো! কী মনে পড়বে?
এই বাক্সটা একদিন তোমার ছিল।
আমি অনিচ্ছেয় মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বললাম, কই জানি না তো!
হয়তো এ জন্মে নয়।
আমি বিস্ময়ে মায়ের মুখের দিকে চাইলাম। আমার মা বাস্তব জগতের মানুষ। কখনও উল্টোপাল্টা কথা বলতে শুনি না। কিন্তু একথাটার কী মানে হয়!
তবে কি আর জন্মে?
বড়মা বিরক্ত হয়ে মাকে বলল, তোর অত ভেঙে বলার দরকারটা কী? বড্ড বোকা তুই।
মা বাক্সর ডালাটা খুলে বলল, দেখ। দেখে নাও।
দেখলাম বাক্সটা ভর্তি মোটা মোটা ভারী ভারী সব পুরোনো গয়না। দেখলে গা বমি-বমি করে। কী বিচ্ছিরি সব জিনিস!
বললাম, দেখার কী আছে। ও তো পুরোনো সব গয়না।
একশ ভরির ওপর। এক রত্তিও এদিক ওদিক হয়নি।
আচ্ছা মা, সকালেই আজ গয়না নিয়ে পড়লে কেন? আমার নিজেরও তো অনেক আছে। পরি কি? গয়না টয়না আমার একদম ভাল লাগে না।
আমার একটা দায়িত্ব ছিল। তাই দেখালাম।
ওসব গয়না কার? তোমার বিয়ের?
না।এসবই তোমার।
আমার চাই না। রেখে দাও।
মায়ের মুখটা এই অন্ধকার ঘরেও হঠাৎ উজ্জ্বল দেখলাম। একটা যেন বদ্ধ উদ্বিগ্ন শ্বাসও ছাড়ল মা।
বড়মা বলল, তোর নাটুকেপনা একটু বন্ধ করবি লতা? মাঝে মাঝে যে তোর মাথায় কী পাগলামি চাপে! ও একরত্তি মেয়ে, আজকালকার ওরা কি ওসব গয়নার দাম দেয়? তুই ক্ষিতীশ স্যাকরাকে ডেকে নতুন করে গড়তে দে কয়েকটা। বেশি করে করার দরকার নেই। স্যাঁকরাদের ঘরের সোনা বেশি না দেখানোই ভাল।
আজকের সকালের নাটকটা কিছু বুঝতে পারছি না আমি। দুজনের মুখের দিকে ঘুরে ঘুরে দেখছি। কী মানে হয় এসব কথার?
মা আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে কেন? কী দেখছে আমার মুখে? আমি তো নতুন কেউ নই!
মা বলল, তোমার অনুমতি নিয়ে আজ বাক্সটা বের করলাম।
আমার অনুমতি! কেন মা? ও গয়না তো আমি জন্মেও দেখিনি। ওটা কার?
মা মাথা নিচু করে বলল, এসব তোমাকে একজন দিয়ে গেছেন। এতদিন আমার কাছে গচ্ছিত ছিল মাত্র।