আমার বন্ধুরা মাঝে মাঝে আড্ডা মারতে চলে আসে আমার কাছে। তিনতলায় এত বড় জায়গা নিয়ে আমি থাকি বলে তারা খুব অবাক হয়। একটু হিংসেও করে কেউ কেউ। আর কেউ কেউ বলে, ও বাবা এ ঘরে একা থাকতে হলে আমি ভূতের ভয়েই মরে যাব। তুই যে কী করে থাকিস! বুকের পাটা আছে বাবা।
সেদিন খুব আড্ডা হচ্ছিল। হঠাৎ চঞ্চল বলল, এই দ্যাখ বসন, তোকে কিন্তু কিডন্যাপ করা হতে পারে।
আমি অবাক হয়ে বলি, কিডন্যাপ করবে? কে করবে রে?
আমার হঠাৎ তোর কথা ভেবে কালকে মনে হল, আরে, বসনটা তো দারুণ টারগেট। ওদের এত টাকা, আর বসন এত আদরের মেয়ে। দিনকাল যা পড়েছে বসনকে কিডন্যাপ করতেই পারে বদমাশরা।
ইন্দ্রাণী বলে, কিডন্যাপ ফিডন্যাপ করবে না। বসনের আসল ভয় অন্য জায়গায়।
কোন জায়গায়?
ওকে বিয়ে করলে তো একটা রাজত্বই পেয়ে যাবে পাত্রপক্ষ। তাই ওকে বিয়ে করতে অনেকে হামলে পড়বে।
কথাটা খুব মিথ্যেও নয়। আমার জ্যেঠুর ছেলেপুলে নেই। বাবা-মার আমি একমাত্র সন্তান। আমি সবই পাব।
তিলক বলে, ডি কে সি কী আর ওকে সাধে বিয়ে করতে চেয়েছিল! না রে বসন, তোর খুব কেয়ারফুল থাকা দরকার।
এমন মুরুব্বির মতো বলল যে আমরা হেসে ফেললাম। আমি বললাম, মারব থাপ্পড়! সবাই বুঝি কেবল আমাকে টাকার জন্য বিয়ে করতে চায়? আর কিছু নয়?
ঝিনুক বলে, তোর মাইরি বই একটু বেশি বেশি আছে। ভগবানের বিচারটাই এমনি।
বাচ্চু নির্বিকার মুখে বলে, বসনটা এমনিতে সুন্দর তবে ওসব ক্লাসিক্যাল সৌন্দর্য এ যুগে চলে না।
আমি অবাক হয়ে বলি, সে কী রে, আমি অচল?
বাচ্চু বিজ্ঞের মতো বলে, তা বলছি না। তবে ওসব টানা টানা চোখ, টোপা টোপা গাল, কোঁকড়া চুল জমিদার মাকা চেহারার কদর নেই। এখনকার টেস্ট আলাদা। দেখিস না হনু উঁচু, গাল বসা, চোখ গর্তে ঢোকানো চেহারার মেয়েদের আজকাল বেছে বেছে সিনেমার নায়িকা করা হচ্ছে।
তিলক বিরক্ত হয়ে বলে, রাখ তো। চেহারা নিয়ে আলোচনাটা বিলো ডিগনিটি। চেহারা জিনিসটাই স্কিন-ডীপ। আসল জিনিস হল পারসোনালিটি।
বন্ধুদের আড্ডা থেকে আমি মনে মনে দূরে সরে যাই। আমি আমার কথা ভাবতে থাকি। আমার এত বেশি আছে কেন? টাকাপয়সা, রূপ, আদর। আমি কি একটু হাঁফিয়ে উঠি? জ্যেঠু, বাবা, ঠাকুমা, বড়মা সকলের নজর সবসময়ে আমার ওপর। আমার দুজন দাদু ছিল। বড় আর ছোটো। দুজনে মিলে আমার মাথা খেয়েছিল আরও বেশি। দুজনেই মারা গেল এক বছরের তফাতে। তবু কি আদর কমছে? একটুও না।
শুধু মা একটু আলাদা। মা ভালবাসে খুব, কিন্তু আসকারা দেয় না। আমার মা কিছু অদ্ভুত। আমার সঙ্গে আমার মায়ের কিছুই মেলে না।
বন্ধুরাও বলে, তোর মা খুব অদ্ভুত, তাই না? এখনও কী রকম পতি ভক্তি!
একথা ঠিক, আমার বন্ধুদের কারও মা বাবার মধ্যেই এমন মিল নেই। বাবাকে মা এত বেশি ভক্তি করে, এত বেশি শ্রদ্ধা করে, আপনি-আজ্ঞে করে, যা আমি কখনও পারব না। অথচ এই সেকেলে মহিলাই গোটা পরিবারটাকে কী নিপুণ দক্ষতায় চালায়। শুনেছি, আমাদের দু-দুটো দোকানের পিছনে মায়েরই চেষ্টা আর পরিশ্রম ছিল। আজ আমাদের যে ফলাও অবস্থা তাও মায়েরই দূরদৃষ্টির ফল। এ সংসার মায়ের কথায় ওঠে-বসে। এক ভেঙেপড়া অবস্থা থেকে মা ধীরে ধীরে এই সংসারটাকে টেনে তুলেছে।
আমার মা যে আমার বাবাকে আপনি-আজ্ঞে করে সেটা আমার কানে অস্বাভাবিক ঠেকত না। কারণ, ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। কিন্তু বন্ধুদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে। তারা জিজ্ঞেস করে, মাসীমা কেন মেসোমশাইকে আপনি করে বলে রে?
আমার লজ্জা করে তখন। মাকে জিজ্ঞেস করি, কেন বাবাকে আপনি বলো মা?
মা জবাব দেয়, বয়সে বড় ছিলেন, ব্যক্তিত্ববান ছিলেন। আপনিটাই এল মুখে। তাতে কোনও ক্ষতি হয়নি কিন্তু।
সকলেরই কি স্বামীকে আপনি বলা উচিত?
তা কেন? যার যেটা ভাল লাগে বলবে। তবে আমি ওঁকে চিরকাল শ্রদ্ধা করেছি বলেই কত জোর পেয়েছি। নইলে সব ভেসে যেত।
একথাটা আমি বুঝতে পারি না। মাকে আর জিজ্ঞেসও করি না কিছু। এ বাড়ির ভিতরে এখনও একটা পুরোনো বনেদি হাওয়া বন্ধ হয়ে আছে। বাইরের পৃথিবী কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে!
তিনতলার ঘরে আজ সকালে আমার ঘুম যখন ভাঙল তখন পূবের জানালা দিয়ে শীতের রোদ ঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও আমার মাথায় ভরে আছে কাল রাতের জ্যোৎস্না, নির্জনতা।
মুখটুখ ধুয়ে নীচে নামতে যাচ্ছি বড়মা উঠে এল ওপরে। বাতের হাঁটু নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে বড়মার কষ্ট হয়। হাঁফাচ্ছে।
বললাম, কেন বড়মা, কষ্ট করে ওপরে ওঠো। সিঁড়ির মুখ থেকে ডাকলেই তো শুনতে পাই।
মুখপুড়ি, কাল রাতে চাটুজ্জে বাড়ির বউটাকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী বলছিলি?
হেসে ফেলি, বেশ করেছি বলেছি। ওরা বউটাকে এত কষ্ট দেয় কেন?
অন্য বাড়ির ব্যাপার নিয়ে তোর মাথা ঘামানোর কী দরকার? শেষে একটা ঝগড়া বাধাবি নাকি? চেঁচিয়ে বলছিলি, পাড়াশুন্ধু শুনেছে। ছিঃ মা, ওরকম বলতে নেই।
আমার খুব ইচ্ছে হয়, বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে এনে ওদের বাড়িতে একদিন হামলা করি।
সে তুমি পারো মা, তোমার অসাধ্য কিছু নেই। শুনলাম কাল নাকি লরিও ঠেলেছিস!
না ঠেললে যে সারা রাত পথে পড়ে থাকতে হত।
বড়মা চোখ বড় করে বলে, আর কী বাকি রইল? মেয়েরা লরি ঠেলে এই প্রথম শুনলাম।