আমি আমার স্বামীকে আকর্ষণ করলাম বিছানায়। আমি আর দেরি করতে পারি না। আমার চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। আমার বুক পুড়ে যাচ্ছে তাপে।
কণ্ঠস্বর অভিশাপ দিচ্ছে, খা… খা… খা… খা… খা… খা…
আমি চোখ বুজে স্বামীকে শক্ত করে ধরলাম বুকে। অধরে অধর। আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, স্তব্ধ হও প্ররোচনা, শান্ত হও তাপিত হৃদয়। জন্ম নাও। জন্ম নাও জন্মের যন্ত্রণা। জন্ম নাও আমাদের ভিতর দিয়ে। শীতল হও, জুড়িয়ে যাও…
বাইরে আমাদের ঘরের চারপাশে শব্দটা ঘুরছে আর ঘুরছে, খা… খা… খা… খা… খা…
আমি বললাম, নিবে যাক বুকের আগুন, শান্ত হোক কামনার জ্বালা, আত্মদমনের যত ক্লেশ। শান্ত হও। এ তোমার জন্মের সময়। শান্ত হও, এ বড় সুন্দর মুহূর্ত। কোল জুড়ে এসো তুমি, বুক জুড়ে এসো। জন্ম নাও… জন্ম নাও… জন্ম নাও…
শব্দ মিলিয়ে গেল। চিরকালের মতো। সম্পূর্ণ হল আমাদের মিলন।
দশ মাস পর আমার মেয়ে হল। বসন্ত কালে তার জন্ম বলে আমরা তার নাম রাখলাম বসন।
বাড়ির কোথাও পিসিমার ছায়া নেই। শব্দ নেই। বাড়ি শান্ত। ভারমুক্ত।
আমি বার বার বসনকে এসে দেখি। সে যেন এক রাশি ফুলের মতো বিছানায় শুয়ে থাকে। এত তার রূপ! আমি তাকে আদর করতে করতে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি, চিনতে পারো আমায়? চেননা এই বাড়ি? মনে পড়ে না?
অবোধ শিশু চেয়ে থাকে।
অনেকদিন বাদে এ বাড়িতে একটি শিশু জন্মাল। তাকে নিয়ে যে টানাহ্যাঁচড়া তা বলার নয়। শাশুড়ি জপতপ প্রায় ছেড়েই দিয়ে নাতনী নিয়ে পড়ে থাকেন। শ্বশুরমশাই মাঝে মাঝেই দোকানে কামাই দিতে লাগলেন। জ্যাঠাশ্বশুর নীচের ঘরে বড় একটা আসতেন না। আজকাল দুবেলা ঘন ঘন যাতায়াত। ভাসুর ভাইঝি পেয়ে এত মুগ্ধ যে, খেলনায় ঘর ভরে ফেলতে লাগলেন। বসনের সময় কাটে কোলে কোলে, আদরে আদরে। তাকে কেউ এক মিনিট ছাড়তে চায় না বলে সে হামা দেওয়া শিখতে পারল না সময়মতো। হাঁটতে শিখল আরও দেরিতে।
বসনকে দেখতেও এলেন না আমার জা। তিনি নীচে নামতে পারেন না। বাত ব্লাডপ্রেশার আরও নানা উপসর্গ নিরানন্দে ঘিরে আছে তাঁকে।
বসন যখন একটু একটু হাঁটতে শিখল তখন একদিন সবার অজান্তে কোন ফাঁকে দুপুরবেলা সিঁড়ি দিয়ে টুক টুক করে ওপরে উঠে গিয়েছিল। তারপর টলোমলো পায়ে সে আমার জায়ের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। মুখে আঙুল পুরে পরম বিস্ময়ে দেখতে লাগল জাকে।
জা বসনকে দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন কে? কে রে?
বুঝতে বোধহয় একটু সময় লেগেছিল তাঁর। এ হল সেই ডাইনীর মেয়ে। তিনি বিছানা থেকেই হাত নেড়ে তাড়িয়ে দিলেন, যা, যা, যা চলে যা এখান থেকে।
কোথায় অভিপ্রেত তারা, কোথায় নয় এটা বাচ্চারা ভালই বোঝে। বসন তাড়া খেয়ে ভয় পেয়ে ফিরে আসতে গেল। কিন্তু নামতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। সিঁড়ি থেকে হুমড়ি খেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল সে। সিঁড়ির পর সিঁড়ি।
কোথা থেকে অচল শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহ এল কে জানে, জা প্রায় উড়ে এলেন তাঁর বিছানা ছেড়ে। ছয় সিঁড়ি নীচে নেমে তুলে নিলেন বসনকে। ব্যথায় নীলবর্ণ হয়ে গিয়েছিল বসন।
শব্দ পেয়ে পাঁচু যখন ওপরে গেল, তখন জা বসনকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন। জলপট্টি দিচ্ছেন ব্যথার জায়গায়।
বাড়ি ছিলাম না। দুপুরে ফিরে শাশুড়ির কাছে ঘটনাটা শুনলাম। উনি মুখ চুন করে বললেন, বড্ড দামাল হয়েছে মেয়েটা। একটু চান করতে গেছি সেই ফাঁকে ওপরে গিয়েছিল। তারপর কী কাণ্ড।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, দিদির ঘরে?
হ্যাঁ মা। এখনও সেই ঘরে আছে। কী হচ্ছে কে জানে? তোমার জায়ের তো বুকে অনেক বিষ। পাঁচুকে পাঠিয়ে মেয়েটিকে আনিয়ে নাও।
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বললাম, থাক মা।
ঠাকুর এসে বলল, বড় বউদি বসনকে ভাত খাওয়াবেন বলে ভাত চেয়ে পাঠালেন। নিয়ে যাব?
আমি বললাম, যাও।
এর পর থেকে বসন রোজ ওপরে যেত বড়মার কাছে। কাউকে জয় করতেই সে বাকি রাখল না।
আমি তাকে একা পেলে এখনও তার মুখে চিহ্ন খুঁজি। তাকে বলি, মনে পড়ে না গয়নার বাক্স? মনে পড়ে না জ্বালা যন্ত্রণা? মনে পড়ে না তোর?
বসন দুর্বোধ্য নানা শব্দ করে কী বলে কে জানে!
৪. বসন
তিনতলার ঘরগুলো যে কেমন হু-হু করে তা আমি বোঝাতে পারব না। তিনখানা মস্ত ঘর নিয়ে আমি একা থাকি। এই একা থাকা আমার মা একটুও পছন্দ করে না। একটা দরদালান আর তিন তিনটে প্রকাণ্ড লোভনীয় ঘর বহুকাল ফাঁকা পড়ে ছিল। ঝাড়পোঁছ, ঝাঁটপাট হত, আবার তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকত। আমি বায়না ধরলাম, তিনতলায় থাকব।
অনেক বারণ, বকাঝকা হল। তারপর পেয়েও গেলাম তিনখানা ঘর নিয়ে আমার রাজত্ব। পাছে ভয় পাই সেইজন্য প্রথম প্রথম মা বা বড়মা এসে থাকত আমার সঙ্গে। কিন্তু আমার ভয় করে না তো! একা থাকতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। আমি টের পাই, তিনখানা ঘর আর দরদালানের ভিতরে এক অদ্ভুত নির্জনতা হুহু করে সারাদিন বয়ে যায়। বাতাসের শব্দ নয়, তবু কী যে হুহু করে তা কে জানে!
তিনটে ঘরে মেলা আসবাব। বিশাল ভারী পালঙ্ক, বড় বড় কাঠের কয়েকটা আলমারি, পাথর-টপ টেবিল, দেয়ালে পেণ্ডুলামওলা মস্ত ঘড়ি। একটা কাচের আলমারিতে সাজানো আছে বিলিতি পুতুল। এসবই আমার এক ঠাকুমার। আমার জন্মের আগেই মারা যান। কী দুঃখের জীবন ছিল তাঁর! সাত বছর বয়সে বিয়ে, বারো বছর বয়সে বিধবা। আমি ভাগ্যিস সে যুগে জন্মাইনি! কী বিচ্ছিরি সিস্টেম ছিল বাবা! আজকালকার মেয়েরা কি আর সাধে নারী-মুক্তি আন্দোলন করে?